ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২

ট্রাম্পের বৈদেশিক সাহায্য কাটছাঁটে ১৪ মিলিয়নের বেশি মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা: গবেষণায় সতর্কবার্তা

প্রকাশিত: ১৭:৫১, ৫ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৭:৫২, ৫ জুলাই ২০২৫

ট্রাম্পের বৈদেশিক সাহায্য কাটছাঁটে ১৪ মিলিয়নের বেশি মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা: গবেষণায় সতর্কবার্তা

আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ, যার এক-তৃতীয়াংশই শিশু, মৃত্যুবরণ করতে পারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈদেশিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে। মর্যাদাপূর্ণ মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় এ ভয়াবহ পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।এই গবেষণা প্রকাশিত হয় এমন এক সময়ে, যখন বিশ্ব নেতারা স্পেনের সেভিয়ায় জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মানবিক সহায়তা খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছেন।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসে ফেরার পর ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID)-এর বাজেট ব্যাপকভাবে ছাঁটাই করে। অথচ এই সংস্থাটি বৈশ্বিক মানবিক সহায়তার অন্তত ৪০ শতাংশ অর্থ যুগিয়ে আসছিল।

 প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক এ বিষয়ে মন্তব্য করে বলেছিলেন, ইউএসএআইডিকে যেন "উডচিপারে" ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গবেষণার সহ-লেখক এবং বার্সেলোনার গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের গবেষক ডাভিদে রাসেলা বলেন, "এই সাহায্য হঠাৎ থেমে গেলে, এমনকি বিপরীতমুখী প্রভাব ফেললে, গত দুই দশকে স্বাস্থ্য খাতে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।" তিনি আরও জানান, এই ধাক্কা অনেক দেশের জন্য মহামারি বা সশস্ত্র সংঘাতের মতো প্রভাব ফেলতে পারে।

গবেষক দলটি ১৩৩টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানায়, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইউএসএআইডি প্রায় ৯১.৮ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সহায়ক হয়েছে। এই সংখ্যাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগে বাড়বে মৃত্যু
গবেষকরা পূর্বাভাস দেন, ইউএসএআইডি-এর বাজেট ৮৩ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার ফলে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হতে পারে। এর মধ্যে ৫ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৭ লাখ শিশুর মৃত্যু হতে পারে।

তুলনা হিসেবে বলা হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১ কোটি সৈন্য নিহত হয়েছিল। ইউএসএআইডি'র সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পগুলোর কারণে সাধারণ মৃত্যুহার ১৫ শতাংশ এবং শিশু মৃত্যুহার ৩২ শতাংশ কমে এসেছে।বিশেষ করে এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও উপেক্ষিত ট্রপিক্যাল রোগগুলোতে ইউএসএআইডি-এর প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। ইউএসএআইডি সহায়তাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে এইচআইভি/এইডসে মৃত্যু ছিল ৬৫ শতাংশ কম। ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগে মৃত্যুও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছিল।

গবেষণার সহ-লেখক ও মোজাম্বিকের মানহিকা হেলথ রিসার্চ সেন্টারের ফ্রান্সিসকো সাউটে বলেন, “আমি নিজের চোখে দেখেছি ইউএসএআইডি কীভাবে এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার মতো রোগ মোকাবিলায় ভূমিকা রেখেছে। এখন এই অর্থ সহায়তা বন্ধ হলে কেবল প্রাণহানি নয়, বরং যে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, তাও ধ্বংস হয়ে যাবে।”

বস্টন ইউনিভার্সিটির গবেষক ব্রুক নিকোলসের তৈরি এক ট্র্যাকার অনুসারে, ইতোমধ্যে এই সাহায্য কমানোর ফলে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক এবং ২ লাখ ২৪ হাজার শিশু মারা গেছে। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৮৮ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন।

ইউএসএআইডি বাজেট কাটার পরে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো অন্য বড় দাতারাও বৈদেশিক সাহায্য কমানোর ঘোষণা দেয়। গবেষকদের মতে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আরও অনেক মৃত্যু ঘটতে পারে।তবে গবেষকেরা মনে করেন, যদি বর্তমান প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ পুনর্বিবেচনা করা হয় এবং বাড়ানো হয়, তাহলে এই ভয়াবহ পূর্বাভাস দ্রুতই পরিবর্তন সম্ভব।

সেভিয়ায় চলমান দশকব্যাপী সর্ববৃহৎ মানবিক সম্মেলনে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নিলেও, যুক্তরাষ্ট্র এতে অংশ নিচ্ছে না। গবেষক রাসেলা বলেন, "এখন সময় সাহায্য কমানোর নয়, বরং তা বাড়ানোর।"গবেষণা অনুযায়ী, ইউএসএআইডি এর বাজেট ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মোট ফেডারেল ব্যয়ের মাত্র ০.৩ শতাংশ।
 

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস ম্যাকিনকো বলেন, “মার্কিন নাগরিকরা প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১৭ সেন্ট, অর্থাৎ বছরে প্রায় ৬৪ ডলার ইউএসএআইডিতে ব্যয় করেন। যদি তারা জানতেন এই ছোট পরিমাণ অর্থ দিয়ে কীভাবে লক্ষ লক্ষ প্রাণ বাঁচানো সম্ভব, তবে তারা নিঃসন্দেহে এ সহায়তা বজায় রাখার পক্ষেই থাকতেন।”

ট্রাম্প প্রশাসনের ইউএসএআইডি বন্ধের সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যখাতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। গবেষকদের আশঙ্কা, এই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত শুধু পরিসংখ্যান নয়, মানবতার জন্য এক ভয়াবহ বার্তা। এখনো সময় আছে, বিশ্ব যদি একত্রে এগিয়ে আসে, তাহলে হয়তো লাখো প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব।

 

 

 

সূত্র:https://tinyurl.com/2r3acsfd

আফরোজা

×