
ছবি : সংগৃহীত
ফুসফুসের ক্যান্সার বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক প্রাণঘাতী ক্যান্সারগুলোর মধ্যে একটি। ধূমপান, বায়ুদূষণ, এবং অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনযাত্রার কারণে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রকোপ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই রোগের মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে।
ফুসফুসের ক্যান্সারের উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে, যা গত দশকের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে মারা যাওয়ার হারও উচ্চ। বিশেষ করে ধূমপায়ীদের মধ্যে এই ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়ে।
বাংলাদেশে অবস্থাও কম সুখকর নয়। জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্র (IEDCR) এর ২০২৪ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, ঢাকার বায়ুদূষণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার কারণে ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আগের তুলনায় ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
কেন বাড়ছে ফুসফুসের ক্যান্সার?
ধূমপান: ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ ধূমপান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ফুসফুসের ক্যান্সারের ৮৫% ঘটনার পিছনে ধূমপানের হাত রয়েছে। ধূমপায়ীদের ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অ-ধূমপায়ীদের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি।
বায়ুদূষণ: বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বাড়তি ধোঁয়া, গাড়ির কালো ধোঁয়া, এবং শিল্প কারখানার দূষণ ফুসফুসের শ্বাসনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে ফুসফুস ক্যান্সারের হার সরাসরি সম্পর্কিত।
কর্মপরিবেশের ঝুঁকি: অ্যাসবেস্টস, রাসায়নিক বাষ্প এবং অন্যান্য টক্সিক পদার্থের সংস্পর্শে থাকার ফলে ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে নির্মাণ শ্রমিক, কারখানা কর্মী এবং রাসায়নিক শিল্পে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি।
পরিবারিক ইতিহাস ও জিনগত কারণ: যারা পরিবারের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী রয়েছে, তাদের ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি।
ফুসফুস ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ
সাধারণত ফুসফুসের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝতে অনেকটা কঠিন। তবে কিছু লক্ষণ যত তাড়াতাড়ি লক্ষ্য করা যায়, তত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করলে রোগের সফল প্রতিরোধ সম্ভব।
🔹 দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা কাশির পরিবর্তন
🔹 বুকের মধ্যে ব্যথা বা অস্বস্তি
🔹 রক্তাক্ত কফ বা রক্তপাত
🔹 শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি
🔹 ওজন কমে যাওয়া বা খাবারের আগ্রহ হারানো
🔹 গলা ব্যথা বা শ্বাস ফেলার সময় কষ্ট
গবেষণা কী বলছে?
জার্নাল অফ ক্যান্সার রিসার্চ (২০২৪) এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শহুরে বায়ুদূষণ বৃদ্ধির সাথে ফুসফুস ক্যান্সারের হার ৩০% পর্যন্ত বেড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ মানের তুলনায় অনেক গুণ বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর রিপোর্ট বলছে, ধূমপান প্রতিরোধ এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে ফুসফুস ক্যান্সারের ৪০-৫০% ঘটনার সম্ভাবনা কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ এবং IEDCR এখন এই রোগের উপর বিশেষ নজর দিচ্ছে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন?
১. ধূমপান এড়িয়ে চলুন: ধূমপান ছেড়ে দিন এবং ধূমপায়ীদের কাছ থেকে দূরে থাকুন।
২. বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে সচেতন থাকুন: দূষিত এলাকা এড়িয়ে চলুন, মাস্ক ব্যবহার করুন, এবং গাছ লাগানোর মাধ্যমে পরিবেশ উন্নত করার চেষ্টা করুন।
৩. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন: বিশেষ করে যারা ধূমপান করেন বা দূষিত এলাকায় থাকেন, তাদের ফুসফুস পরীক্ষা করানো জরুরি।
৪. সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খান: ফল-মূল, শাক-সবজি বেশি খান যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৫. কর্মপরিবেশ নিরাপদ করুন: রাসায়নিক ও ক্ষতিকর পদার্থ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন।
ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধ ও দ্রুত সনাক্তকরণ ছাড়া এই রোগ থেকে বাঁচা কঠিন। তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো অপরিহার্য। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এই রোগ প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমাদের প্রত্যেককে নিজের ও পরিবারের ফুসফুসের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ স্বাস্থ্যই জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
Mily