
ছবি: সংগৃহীত
ঘুমে কথা বলা মজার মনে হলেও এটি অনেক সময় গভীর কিছু সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। কখনও হয় অস্পষ্ট গুঞ্জন, কখনও হাসি, আবার কখনও মাঝরাতে পুরো বক্তৃতা! অথচ পাশেই ঘুমিয়ে থাকা মানুষটি জানেই না, তারা কী বলেছে। ঘুমে কথা বলা—যাকে চিকিৎসা ভাষায় সোমনিলকি (Somniloquy) বলা হয়—আদতে একটি সাধারণ পারাসমনিয়া (parasomnia), অর্থাৎ এমন ঘুম সংক্রান্ত অবস্থা যেখানে ঘুমের সময় অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দেয়।
অনেকেই একে গুরুত্ব না দিয়ে মজা করে উড়িয়ে দেন, কিন্তু নিয়মিত বা তীব্রভাবে ঘুমে কথা বলার ঘটনা হলে তা ঘুমের ঘাটতি, মানসিক চাপ বা ঘুমের স্বাভাবিক চক্রের ব্যাঘাতের ইঙ্গিত হতে পারে। এর কারণ বুঝতে পারলে ঘুমের মান উন্নত করা সম্ভব, শুধু আপনার নয়, পাশের মানুষটিরও।
ঘুমে কথা বলা কী এবং কী কারণে হয়?
ঘুমে কথা বলা তখন হয়, যখন মস্তিষ্ক জেগে থাকা ও ঘুমের মাঝামাঝি এক অবস্থায় চলে যায়। শরীর ঘুমিয়ে থাকলেও, মস্তিষ্কের ভাষা সংশ্লিষ্ট অংশ কিছুক্ষণের জন্য সক্রিয় হয়ে যায়। তখন কেউ অস্পষ্ট শব্দ করতে পারে, কেউ আবার পুরো বাক্য বলতেও পারে।
এটি ঘুমের যেকোনো স্তরে ঘটতে পারে, তবে সাধারণত হালকা ঘুমের সময়—বিশেষ করে REM (Rapid Eye Movement) পর্যায়ে বেশি দেখা যায়, যখন আমরা স্বপ্ন দেখি। কিছু মানুষ মাঝে মাঝে কথা বলেন, আবার কেউ প্রায় প্রতিদিনই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা জানেন না বা পরে মনে রাখতে পারেন না, তারা কিছু বলেছেন।
একটি নির্দিষ্ট কারণ সবসময় জানা যায় না, তবে কিছু সাধারণ উদ্দীপক বা উদ্রেককারী বিষয় ঘুমে কথা বলার ঝুঁকি বাড়ায়:
-
চাপ ও উদ্বেগ: মানসিক চাপ ঘুমে অস্থিরতা বা কথা বলার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।
-
ঘুমের ঘাটতি: পর্যাপ্ত ও গভীর ঘুমের অভাবে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক চক্র ব্যাহত হয়।
-
জ্বর বা অসুস্থতা: শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বা শারীরিক অস্বস্তি থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, ফলে কথা বলা দেখা যায়।
-
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: PTSD (ট্রমা), হতাশা ইত্যাদি ঘন ঘন ঘুমে কথা বলার কারণ হতে পারে।
-
জেনেটিক কারণ: পরিবারে কারও থাকলে আপনার হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
-
ওষুধ বা মাদকদ্রব্য: কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, ঘুমের ওষুধ বা নেশাজাত দ্রব্য ঘুমের সময় মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলে।
কখনও কখনও ঘুমে কথা বলা নাইট টেরর, REM স্লিপ বিহেভিয়ার ডিজঅর্ডার, বা স্লিপ অ্যাপনিয়া-এর মতো অন্যান্য ঘুম সংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে মিলেও দেখা দিতে পারে। তাই ঘন ঘন বা তীব্র হলে এর দিকে নজর দেওয়া জরুরি।
ঘুমে কথা বলা কি বিপজ্জনক?
সাধারণত ঘুমে কথা বলা ক্ষতিকর নয়। ব্যক্তি নিজের অজান্তেই বলে থাকেন এবং এতে তার ঘুমও ভাঙে না। বরং এতে বেশি বিরক্ত হন পাশের মানুষটি।
তবে যখন এটি ঘন ঘন হয়, উচ্চস্বরে হয়, বা এতে চিৎকার, কান্না, ঝগড়া বা মানসিক অস্থিরতার অভিব্যক্তি থাকে, তখন তা গভীর সমস্যা—যেমন মানসিক চাপ বা আবেগগত দ্বন্দ্ব—এর ইঙ্গিত হতে পারে।
এটা শুধুমাত্র ঘুমের অস্বাভাবিক আচরণ না, বরং মস্তিষ্কের বার্তা। বারবার হলে তাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, কারণ তা হতে পারে আপনার অবচেতন মনের উদ্বেগ বা চাপের বহিঃপ্রকাশ।
ঘুমে কথা বলার সমাধান বা করণীয়
যদি মাঝে মাঝে হয় এবং হালকা ধরনের হয়, তবে চিন্তার তেমন কিছু নেই। তবে যদি তা নিয়মিত, আবেগপ্রবণ, বা কারও ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়, তাহলে নিচের বিষয়গুলো সাহায্য করতে পারে:
ভালো ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও উঠার অভ্যাস করুন।
চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন: জার্নাল লেখা, মেডিটেশন, বা থেরাপি মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
ঘুমের আগে উত্তেজক কিছু এড়িয়ে চলুন: ক্যাফেইন, এলকোহল বা ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন ঘুমের আগে।
ঘুমের পরিবেশ শান্ত করুন: ঠান্ডা, অন্ধকার ও নিরিবিলি ঘর ভালো ঘুমে সহায়তা করে।
ঘুম ট্র্যাক করুন: একটি ঘুমের ডায়েরি রাখুন—কখন হয়, কী ঘটেছিল, কী খেয়েছেন ইত্যাদি লিখে রাখুন।
যদি ঘুমে কথা বলার সঙ্গে শারীরিক নড়াচড়া, চিৎকার, বা অন্য ঘুমের ব্যাঘাত দেখা যায়, তাহলে ঘুম বিশেষজ্ঞ দেখানো ভালো। প্রয়োজনে তাঁরা স্লিপ স্টাডি করার পরামর্শ দিতে পারেন, যাতে প্রকৃত কারণ শনাক্ত করা যায়।
আবির