
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নিকট সোমবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়
পেশাদারত্ব, দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডার পুনর্গঠনের মাধ্যমে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস (বিএইচএস) গঠন করার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। একটি অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে এটি করা সম্ভব বলে মনে করে এই কমিশন। এছাড়া একটি স্বতন্ত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সংস্কার কমিশনের ৩২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়মের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করা হয়।
সর্বজনীন ও সহজলভ্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাতের সঙ্গে এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে অংশিদারত্বের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে সেবার ব্যবস্থাপনা করতে হবে বলে মনে করে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন। বিদ্যমান স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট ক্যাডারগুলোকে পুনর্গঠনপূর্বক একটি পেশাভিত্তিক, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পৃথক এবং স্বাধীন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যার নেতৃত্বে থাকবে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় ও একজন মুখ্য সচিব মর্যাদাসম্পন্ন চিকিৎসক।
বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠন প্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসের অধীনে তিনটি খাত ক্লিনিক্যাল সেবা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা পরিচালনা করবেন সংশ্লিষ্ট উপ-প্রধান ও মহাপরিচালকরা। বিভাগীয় পর্যায়ে ১১টি আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ থাকবে এবং বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ, বাজেট ও পরিকল্পনায় আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা দিয়ে কার্যকর, স্থানীয় চাহিদাভিত্তিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রস্তাবিত রূপান্তর প্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, নার্সিং, তামাক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) এবং যানবাহন ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থা (টেমো)কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে একীভূত করা হবে। এসব সংস্থার সেবা প্রস্তাবিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসেস-এর সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরগুলোর সঙ্গে উপযুক্তভাবে একীভূত করা হবে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিত ক্যাডারে রূপান্তর করার কথা বলা হয়েছে। এই ক্যাডারটি বিচারিক ক্যাডারের ন্যায় একটি স্বাধীন সিভিল সার্ভিস ক্যাডার হবে এবং এর নাম হবে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসেস। প্রত্যেক কর্মকর্তাকে বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরিবার পরিকল্পনা (সাধারণ) কর্মকর্তাদের শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিশনের প্রস্তাবিত নতুন ক্যাডারে একীভূত করা হবে। তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থাও থাকবে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের সেবায় শিক্ষা, দক্ষতা ও পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে একীভূত করা হবে। তাদেরও বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে।
প্রতিবেদনে গ্রামে এবং শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে প্রাথমিক সেবা চিকিৎসক নিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। গ্রামে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য-উপকেন্দ্র ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র একত্র করে এবং শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক কেন্দ্র গড়ে প্রথম স্তরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রেফারেল ব্যবস্থা কাঠামোবদ্ধ ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক রেফারেল ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে রোগী সঠিক সময়ে সঠিক স্তরের সেবা পায় এবং উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে ভিড় কমে।
পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। যোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নিয়োগের সুপারিশ করার জন্য উচ্চপর্যায়ের সার্চ কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদ যেমন বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস প্রধান ও উপ-প্রধান, মহাপরিচালক, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রো-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ, বিএমডিসি ও বিএমআরসি-এর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা সম্পর্কে জাতীয় সংসদকে অবহিত করতে হবে।
প্রতিবেদনে অনিয়মের চিত্র ॥ প্রতিবেদনে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের পাবলিক ফিন্যান্স ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৮ হাজারের বেশি নিরীক্ষা আপত্তি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এর মধ্যে অনেকগুলো ১৯৯৮-২০০৩ সালের প্রথম সেক্টর প্রোগ্রামের সময়কার।
এই আপত্তিগুলোর আর্থিক মূল্য রাজস্ব বাজেটে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন বাজেটে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। এর প্রায় ৯৫ শতাংশ আপত্তি রাজস্ব বাজেট সম্পর্কিত, যার বেশিরভাগই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন। এই পরিস্থিতি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং জবাবদিহির ঘাটতির একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে বলে মনে করে কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা থাকলেও বাস্তবে বহু অনিয়ম বিদ্যমান। সরকারি নিরীক্ষা ব্যবস্থা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও নিরীক্ষা ইউনিট এবং ফিডিউশিয়ারি অ্যাকশন প্ল্যান থাকা সত্ত্বেও বহু নিরীক্ষা আপত্তি অমীমাংসিত থেকে গেছে।
অর্থ ব্যবস্থাপনা ও অডিট ইউনিটের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সেক্টরওয়াইড প্রোগ্রামের শুরু থেকেই অর্থ ব্যবস্থাপনা ও অডিট ইউনিট সক্রিয় রয়েছে। উন্নয়ন সহযোগীদের চাপের ফলে, ইউনিটটির কাঠামো আনুষ্ঠানিকভাবে গঠনের দিকে কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং জনবলও বৃদ্ধি পেয়েছে। চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রামের (২০২৪) শেষ নাগাদ, আগের যেসব অভ্যন্তরীণ অডিট আউটসোর্স করা হতো, সেগুলো এখন অর্থ ব্যবস্থাপনা ও অডিট ইউনিট নিজেই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবায়ন পর্যায়ে বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর্থিক ও হিসাব সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অডিট আপত্তি রয়ে গেছে। বিভাগীয় সচিব, যিনি প্রধান হিসাব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনিই সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য চূড়ান্তভাবে দায়ী। কিন্তু অডিট আপত্তিগুলোর সুষ্ঠু নিষ্পত্তি না হওয়ায় এই দায়িত্ব আরও জটিল ও চাপপূর্ণ হয়ে উঠছে। অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিতে এই ব্যর্থতা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার দুর্বলতাকেও নির্দেশ করে। এটা পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একটি বড় ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক তদারকি ব্যবস্থা দুর্বলতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক তদারকি ব্যবস্থাগুলো বর্তমান আর্থিক অনিয়ম ও অডিট আপত্তিগুলো যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না। যদিও সরকারি অডিট এবং ফিডিউশিয়ারি অ্যাকশন প্ল্যানের মতো ব্যবস্থা চালু আছে, তবুও বহু সমস্যার অমীমাংসিত রয়ে যাওয়া ইঙ্গিত দেয় যে, সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।