ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

প্রসঙ্গ ভিটিলিগো

ডা. এস এম বখতিয়ার কামাল

প্রকাশিত: ২০:৩০, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রসঙ্গ ভিটিলিগো

.

এখন প্রশ্ন হলো কি কারণের জন্য ভিটিলিগো বা শ্বেতি হয়? এখন একথা মনে আসতে পারে যে শরীরে মেলানিনের অভাব কেন হয়?

কাদের মধ্যে ভিটিলিগো বা শ্বেতিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে?

শ্বেতি বা ভিটিলিগোর প্রাথমিক লক্ষণ ভিটিলিগোর প্রকারভেদ :

আবার আক্রান্ত কলা কোষের ওপর ভিত্তি করে ভিটিলিগো নানা ধরনের হয়-

ভিটিলিগোর চিকিৎসা

এখন অনেকের মনে এই প্রশ্ন আসে যে, শ্বেতি হলে দুধ পান করা উচিত কিনা?

ভিটিলিগো প্রতিরোধের উপায়

রাস্তাঘাটে প্রায়শই এমন কিছু মানুষের দেখা মেলে যাদের ত্বকে অল্প-বিস্তর ছোপ ছোপ সাদা রং দেখা যায়। যার ফলে অনেক মানুষের ভিড়ে এই ধরনের মানুষকে সহজেই আলাদা করা যায়। কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে ধরনের ব্যক্তিদের আড়ষ্টতা চোখ এড়ায় না।

আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় হলো ত্বকের সাদা দাগ, চলতি কথায় অনেকে একে শ্বেতী বলে। আর ডাক্তারি পরিভাষায় যা ভিটিলিগো নামে পরিচিত।

ভিটিলিগো (vit-ih-LIE-go) হলো এমন একটি রোগ যার কারণে ত্বকের বর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। বিবর্ণ অঞ্চলটি সাধারণত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে। এই সাদা সাদা দাগ বা ছোপ হওয়া শরীরের যে কোনো অংশের ত্বকের ওপর থেকেই শুরু হতে পারে। চুল, ভ্রু এমনকি মুখের ভিতরেও এটা হতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো কি কারণের জন্য ভিটিলিগো বা শ্বেতী হয়?

একাধিক কারণের জন্য বয়সভেদে মানবদেহের ত্বকের বিভিন্ন জায়গায় শ্বেতী দেখা দিতে পারে যেগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো -

ভিটিলিগোর কারণ : প্রথমত, মানব দেহের ত্বক এবং চুলের রং মেলানিন দ্বারা নির্ধারিত হয়। যখন মেলানিন উৎপাদনকারী কোষগুলো মারা যায় বা কাজ করা বন্ধ করে দেয় তখনই চামড়ার ওপর ভিটিলিগো বা শ্বেতী দেখা যায়।

দ্বিতীয়ত, উপরের কারণটি ছাড়াও আরও নানা কারণে শ্বেতী দেখা দিতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রসাধনীর ব্যবহার, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের চটি, বেল্টের মতো কোনোকিছু এককভাবে শরীরের এক জায়গায় চেপে বসে থাকার মতো বিষয়গুলো।

ভিটিলিগো সব ধরনের ত্বকের মানুষকে প্রভাবিত করে, তবে বাদামী বা কালো ত্বকের লোকদের মধ্যে এটি আরও স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। এটা অবশ্য জীবননাশক বা সংক্রামক নয়। তবুও এর সঙ্গে জড়িত মানুষের নানা কুসংস্কারের কারণে এই রোগটির একটা সামাজিক প্রভাব আছে যা আপনাকে স্বাভাবিকভাবেই একটা চাপে ফেলে দেয়। যা হতে পারে আপনার নিজের সম্পর্কে একটা খারাপ বোধ বা অস্বস্তি সংকোচ তৈরি হওয়া।

এখন একথা মনে আসতে পারে যে শরীরে মেলানিনের অভাব কেন হয়?

প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, দেহে মেলানিনের অভাব কেন হয় তার কারণ এখনো অজানা। তবে নিম্নলিখিত কিছু বিষয় এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে বলে মনে করা যায়।

একটি অটোইমিউন অবস্থা : এই পরিস্থিতিতে আপনার নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম স্ব-মেলানোসাইট কোষগুলোকে বহিরাগত আক্রমণকারী হিসেবে ভুল করে। এর ফলে আপনার শরীরের প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী কোষগুলো নিজের দেহের কিছু কোষকে (মেলানোসাইট) শত্রু ভেবে ধ্বংস করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। ফলে আপনার শরীরে, বিশেষত ত্বকে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

জেনেটিক মিউটেশন : জেনেটিক মিউটেশন হলো আপনার শরীরের ডিএনএ এর ভিতরে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন যা আপনার মেলানোসাইটের কাজকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রায় ৩০টিরও বেশি জিন ভিটিলিগো হওয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে বলে মনে করা হয়।

স্ট্রেস : শারীরিক এবং মানসিক চাপের প্রভাব মেলানোসাইট কোষগুলোর ওপর পড়ে। যদি কোনো রকম শারীরিক আঘাত পান তাহলে এই চাপ আরও বেড়ে যায়। এর ফলে মেলানোসাইট রঞ্জক উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

পরিবেশগত প্রভাব : সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির বিকিরণ এবং বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আপনার দেহের মেলানোসাইট কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে আপনি শ্বেতী বা ভিটিলিগোর শিকার হয়ে পড়তে পারেন।

কাদের মধ্যে ভিটিলিগো বা শ্বেতীতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে?

ভিটিলিগো হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোনো মানুষের যে কোনো সময়ে এই রোগটি হতে পারে। সাধারণত ৩০ বছর বয়সের আগে ম্যাকুলস বা প্যাচগুলো স্পষ্ট হয়ে যায়। আপনি যদি কোনো অটো ইমিউন ডিজিজ বা অ্যাডিসিন রোগে আগে থেকে আক্রান্ত থাকেন তাহলে সেক্ষেত্রে ভিটিলিগো হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

শ্বেতী বা ভিটিলিগোর প্রাথমিক লক্ষণ

ত্বকে প্রকাশ পাওয়া যেকোনো সাদা দাগ মানেই কিন্তু তা শ্বেতী নয়। তবে শ্বেতীর ক্ষেত্রে তা প্রাথমিকভাবে মুখ, বাহু, হাত, শরীরের খোলা জায়গা, যৌনাঙ্গের চারপাশের অঞ্চল এবং নিতম্বসহ শরীরের যে কোনো জায়গার ত্বকে বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট সাদা দাগ হিসেবে দেখা দিতে পারে, যা ভিটিলিগোর প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।

এছাড়াও দুটি চোখের মাঝখানে, মাথার চামড়ায়, ভ্রু, এমনকি দাড়িতে পর্যন্ত এটা শুরু হতে পারে। দাড়ি এবং চুল ফ্যাকাশে হয়ে যেতে পারে।

মুখ এবং নাকের মিউকাস মেমব্রেনে রঙের প্রলেপ উঠে যেতে পারে।

ভিটিলিগোর প্রকারভেদ

মানবদেহে এর তীব্রতা, ধরণ স্থায়িত্বের ভিত্তিতে ভিটিলিগো বা শ্বেতী নানা প্রকারের হয়ে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে-

যখন শরীরের অনেকাংশে একসঙ্গে সাদা সাদা দাগ দেখা যায় তখন তাকে সাধারণ ভিটিলিগো বলে। এগুলো সাধারণত একসঙ্গে বাড়তে থাকে।

যদি শরীরের একপাশে বিবর্ণতা দেখা যায় তাহলে তাকে সেগ্মেন্টাল ভিটিলিগো বলে। এটা সাধারণত অল্প বয়সে শুরু হয় এবং এক বা দুই বছর থাকার পর বন্ধ হয়ে যায়।

যখন শরীরের একটি মাত্র অঞ্চলে ভিটিলিগো সীমাবদ্ধ থাকে তখন তাকে লোকালাইজড ভিটিলিগো বলে।

আবার শুধু মুখ হাতের যদি এই অসুখটি হয় তখন তাকে অ্যাক্রোফেসিয়াল ভিটিলিগো বলে।

আবার আক্রান্ত কলা কোষের ওপর ভিত্তি করে ভিটিলিগো নানা ধরনের হয়-

মিউকোসাল : এই প্রকারের ভিটিলিগো মুখ, নাক, যৌনাঙ্গের শ্লেষ্মা ঝিল্লিকে আক্রান্ত করে।

ট্রাইকোম : প্রথমে বর্ণহীন বা সাদা বুলসি তৈরি হয় সেখান থেকে ত্বকে হালকা পিগমেন্টেশন শুরু হয়।

সর্বজনীন : এটি একটি বিরল প্রকৃতির ভিটিলিগো যেখানে সারা শরীরের ত্বকের প্রায় ৮০% অঞ্চলে রঞ্জক পদার্থ থাকে না।

ভিটিলিগোর চিকিৎসা

সত্যি বলতে ভিটিলিগোর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। আসল কথা হলো এর চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কারণ শ্বেতী থেকে জীবনহানি ঘটার সম্ভাবনা একেবারেই নেই বললে চলে। তবে কর্টিকোস্টেরয়েড, টপিকাল জানুস কিনেস ইনহিবিটরস (রাক্সোলিটিনিব), ক্যালসিনুরিন ইনহিবিটরস জাতীয় কিছু ওষুধ রয়েছে যা পিগমেন্টেশন হ্রাসের গতি কমিয়ে দিতে পারে। যদি এটা ঠোঁট এবং নখের ডগা পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে অটোলোগাস মেলানোসাইট ট্রান্সপ্লান্ট করা যেতে পারে। গুরুতর সমস্যার ক্ষেত্রে হাল আমলে স্কিন গ্রাফটিং চালু হয়েছে। আর মানসিকভাবে আহত হলে কাউন্সিলিং করাতে পারেন।

এগুলো ছাড়াও বর্তমানে শ্বেতীর চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েকটি থেরাপি রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে এবার জেনে রাখুন-

আলোক থেরাপি বা ফটোথেরাপি- এটি হলো এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতি যা আপনার ত্বকে রং ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির- বি (UVB) লাইট বা আপনার ত্বকে নির্দেশিত মেডিকেল-গ্রেড লেজারগুলো অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। আপনার ত্বকের ওপর এর ফলাফল বোঝার জন্য আপনাকে বেশ কয়েকটি ফটোথেরাপি সেশন নিতে হতে পারে। মুখে খাওয়ার ওষুধ এবং আল্ট্রাভায়োলেট লাইট (PUVA) একত্রিত করে ত্বকের বড় অংশে ভিটিলিগোর চিকিৎসা করা হয়। এটি মাথা, ঘাড়, গর্দান, উপরের বাহু এবং পায়ের ক্ষেত্রে ভিটিলিগোর চিকিৎসার জন্য কার্যকর। তবে পুরো প্রক্রিয়াটি অবশ্যই বিশষজ্ঞদের পরামর্শ এবং তত্ত্বাবধানে করা উচিত।

ডিপিগমেন্টেশন থেরাপি : এই পদ্ধতিতে ভিটিলিগোতে আক্রান্ত ত্বকের অংশগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে আপনার ত্বকের স্বাভাবিক রংকে ফিকে করে সমতা আনার চেষ্টা করা হয়। ডিপিগমেন্টেশন থেরাপিতে মনোবেনজোন ড্রাগ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আপনি আপনার ত্বকের পিগমেন্টেড প্যাঁচগুলোতে এই ওষুধটি প্রয়োগ করতে পারেন। এটি আপনার ত্বককে সাদা করে তুলবে যাতে আপনার ত্বকের অংশগুলো ভিটিলিগোর সঙ্গে মেলে।

স্কিন গ্রাফটিং : এই চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে আপনার শরীরের এক অংশ থেকে চামড়া নিয়ে অন্য অংশ ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। ত্বকের সাধারণ দাগ বা সংক্রমণজনিত প্যাঁচ এর মাধ্যমে দূর করা যায়।

ব্লিস্টার গ্রাফটিং : এক্ষেত্রে ব্লিস্টারের মাধ্যমে গ্রাফটিং করা হয়।

এখন অনেকের মনে এই প্রশ্ন আসে যে, শ্বেতী হলে দুধ পান করা উচিত কিনা?

বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, ভিটামিন , সি, এবং কে মেলানোসাইটের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। দুধে সকল ভিটামিনগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকে। এছাড়াও ডিম, পনির, গাজর, দই, চিয়া বীজ, ওটমিল, আদা, তরমুজ, কিউই, পেঁপে, শুকনো ফল এবং সবুজ শাক-সবজি এই তালিকার মধ্যে পড়ে যেগুলো শরীরের মেলানিন কমাতে সাহায্য করে।

ভিটিলিগোর সে অর্থে কোনো প্রতিকার নেই কিন্তু আপনি যদি চিকিৎসা নিতেই চান, তাহলে আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী আপনাকে আপনার এবং আপনার ত্বকের জন্য সঠিক চিকিৎসা বেছে নিতে সাহায্য করবেন।

সবশেষে যেটা বলার, ভিটিলিগো বা শ্বেতী কোনো স্বাস্থ্যহানিকারক জটিল রোগ নয়। এটি কোনোভাবেই ছোঁয়াচে নয়। এর সঙ্গে কুষ্ঠ রোগের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই। এটি শারীরিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে না। একজন শ্বেতী রোগী অনায়াসে স্বাভাবিক জীবনযাপনের যোগ্য। তাই অযথা রটে থাকা সামাজিক কুসংস্কার আত্মসংকোচবোধ ঝেড়ে ফেলুন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আনন্দে স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করুন।

তবে যেকোনো চিকিৎসা পদ্ধতিই একজন অভিজ্ঞ চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ মেনে প্রয়োগ করা উচিত।

ভিটিলিগো প্রতিরোধের উপায়

যেহেতু ভিটিলিগোর বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, তাই এটি প্রতিরোধ করার কোনো সুনির্দিষ্ট উপায় প্রায় নেই বললেই চলে। তবে আপনি ভিটিলিগো বা শ্বেতি হওয়ার ঝুঁকি যেভাবে কমাতে পারেন তা হলো-

নিরাপদে সূর্যের আলো শরীরে লাগান।

প্রতিদিন একটি ভালো ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন এবং আপনার ত্বকের যত্ন নিন।

শরীরে অতিরিক্ত চাপ এবং আঘাত এড়িয়ে চলুন।

লেখক : অধ্যাপক চর্ম, যৌন, এলার্জি চুল রোগ বিশেষজ্ঞ চেম্বার ডা. কামাল হেয়ার অ্যান্ড স্কিন সেন্টার ১৪৪ ইঞও সেন্টারা গ্রীন রোড ফার্মগেট টাকা- ০১৭১১৪৪০৫৫৮

×