
দৈনন্দিন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ এখন একটি শব্দের সঙ্গে বেশ পরিচিত। কোলেস্টেরল। শরীরে কতটুকু কোলেস্টেরল। রক্তে কতটুকু কোলেস্টেরল, এ নিয়ে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং মানুষ এখন শরীর সচেতন। কিন্তু এই কোলেস্টেরল কি অথবা কেন শরীরের ব্লাড প্রেশার থেকে হার্ট বিষয়ক জটিলতায় কোলেস্টেরলের ভূমিকা থাকে। কেন রক্তে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি কোলেস্টেরল শরীরের জন্য খারাপ, হৃদপি-ের জন্য খারাপ, রক্ত চলাচলে খারাপ এবং মুহূর্তে মৃত্যু এনে দেয়ার মতো ধ্বংসাত্মক মাত্রা, সে সম্পর্কে জানা তাই জরুরী।
কোলেস্টেরলের কম বেশি হার্টের বিভিন্ন রোগের চিহ্নকে বহন করে। বিশেষ করে স্ট্রোকের ক্ষেত্রে একটি প্রধান কালপ্রিট। সঙ্গে আছে হার্ট এট্যাক থেকে কার্ডিয়াক এরেস্ট, হার্ট ফেইলুর থেকে হাই ব্লাড প্রেশার, অনেক কিছুর সঙ্গেই রক্তে বেশি মাত্রায় কোলেস্টেরলে উপস্থিতি দায়ী।
কোলেস্টেরল। এটি এক ধরনের ফ্যাট। এটি শরীরের প্রতিটি কোষে থাকে। বিশেষ করে কোষের মেমব্রেন এবং কোষের ভেতরে। বিভিন্ন হরমোন তৈরি, কোষের মেমব্রেন তৈরি, ভিটামিন ডি উৎপাদন, ব্রেন এবং পাকস্থলীর বিভিন্ন কাজে হেল্প করা এই কোলেস্টেরলের কাজ। তখন কোলেস্টেরলকে রক্তের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে হয় এই কাজগুলোর জন্য। তবে কোলেস্টেরল একা ঘুরে বেড়াতে পারে না রক্তে। রক্তের ভেতর কোলেস্টেরলকে বলে লিপিড। এই লিপিড প্রোটিনের সঙ্গে গাঁট বেঁধে রক্তে থাকে এবং শরীরের যেখানে দরকার ছুটে যায়। প্রোটিন এবং লিপিডকে তখন এক সঙ্গে বলে লিপপ্রোটিন। এমন করে লিভার থেকে তৈরি হওয়া কোলেস্টেরল রক্তে লিপপ্রোটিন আকারে ঘুরে বেড়ায়।
কোষে, কোষের বাহিরে, কোষের প্রাচীরে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এই কোলেস্টেরলের বেশিরভাগ তৈরি করে লিভার। অল্প কিছু তৈরি হয় অন্ত্রে। লিভারের কোষের ভেতর এই কোলেস্টেরল তৈরি হতে ৩৭টি স্টেপ অতিক্রম করতে হয়।
ঋৎধহম্ফড়রং চড়ঁষষবঃরবৎ ফব ষধ ঝধষষব নামের এক ফ্রেঞ্চ ডাক্তার ১৭৯৬ সালে সর্ব প্রথম কোলেস্টেরল খুঁজে পান শরীরে। পরবর্তীতে ১৮১৫ সালে আরেক ফ্রেঞ্চ কেমিস্ট গরপযবষ ঊঁমèহব ঈযবাৎবঁষ. উপাদানটির নাম দেন - ঈযড়ষবংঃবৎড়ষ।
শরীরের প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরলের উৎস দুটি। শরীরের ভেতর লিভার এবং শরীরের বাহিরে বিভিন্ন ধরনের খাবার।
সুতরাং, শুরুতে এটি ধরে নিতে হয়- কোলেস্টেরল শরীরের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। এটি ক্ষতিকর কিছু নয়। তবে বেশি কোলেস্টেরল শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অনেক ধরনের ক্ষতির মধ্যে রক্তে জমাট বেঁধে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এমন করে ব্রেনে রক্ত চলাচলে বাধা দিলে পরিণতিতে যা হয়, সেটা হলো স্ট্রোক। আবার হৃদপি-ে রক্ত চলাচলে বাঁধা দিলে হয় হার্ট এট্যাক কিংবা কার্ডিয়াক এরেস্টের মতো মৃত্যুঘাতী মুহূর্ত।
কিন্তু প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরল শরীরের কয়েকটি জায়গায় খুব প্রয়োজন। ব্রেন, হার্ট, নার্ভ, অন্ত্র এবং স্কিনে। স্কিনে ভিটামিন ডি তৈরিতে এটি সাহায্য করে। পেটে বাইল জোগান এবং লিভার থেকে উৎপাদনে সাহায্য করে, যা পরবর্তীতে ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাদ্যকে পরিপাক করতে সাহায্য করে। এটি বিভিন্ন ধরনের স্টেরয়েড হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে, যা আমাদের হাড় থেকে পেশিতে কাজ করে। দাঁত থেকে মস্তিষ্কে কাজ করে। সমস্যা হয় তখনই, যখন শরীরের এই প্রয়োজনের বেশি কোলেস্টেরল শরীরে উপস্থিত থাকে, জমা হতে থাকে, উৎপাদন হতে থাকে।
কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে পারে কয়েকটি কারণে।
এক. জেনেটিক্স।
দুই. অলস পরিশ্রমহীন অথবা ব্যায়ামহীন জীবন।
তিন. অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া।
চার. অতিরিক্ত ধূমপান এবং মদ্যপান করলে।
বেশিভাগ লোকের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ খাদ্য। ভুল খাবার। বিশেষ করে স্যাচুরেটেড ফ্যাট খাবার। যেমন- মাংস, দুধ, পামওয়েল, কোকোনাট অয়েল, বাটার, দই, চকোলেট, পনির , বিস্কুট, কেক এবং বিভিন্ন ভাজা পোড়া খাদ্য।
এসব খাদ্যে অনেক পরিমাণ স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। এটি খারাপ ফ্যাট। কারণ হলো- এই ফ্যাট লিভারের খউখ জাতীয় ফ্যাটের রিসেপ্টরের কাজে বাধা দেয়। এতে লিভার খউখ জাতীয় ফ্যাটকে রক্তে নিয়ন্ত্রণে বাধাগ্রস্ত হয় এবং রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। তবে অল্প পরিমাণ স্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরের তেমন ক্ষতি করে না। দৈনিক ২০ থেকে ৩০ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট রিকোমেন্ডেড মাত্রা।
রক্তে কোলেস্টেরল লিপিড আকারে থাকে। এই লিপিড রক্তের প্রোটিনের সঙ্গে একজোট হয়ে লিপপ্রোটিন আকারে থাকে। রক্তের এই কোলেস্টেরল কয়েক প্রকারের হয়।
LDL cholesterol ev low density lipoprotein। এটিকে বলে খারাপ কোলেস্টেরল। কারণ এটিতে অনেক বেশি পরিমাণ লিপিড থাকে, কম পরিমাণ প্রোটিন থাকে। বেশি লিপিড থাকা মানে বেশি কোলেস্টেরল থাকা রক্তে। তাই রক্তে এটি বেড়ে গেলে বুঝবেন শরীরের ক্ষতি হতে পারে।
HDL cholesterol ev high density lipoprotein। এটিকে বলে ভাল কোলেস্টেরল। কারণ এতে বেশি পরিমাণ প্রোটিন থাকে কিন্তু অল্প লিপিড বা কোলেস্টেরল থাকে। রক্তে ঐউখ বেশি থাকলে ভাল। কারণ এটির প্রোটিন রক্ত থেকে কোলেস্টেরলকে নিয়ে লিভারে ছেড়ে দিয়ে ভেঙে ফেলে, এতে রক্তে কোলেস্টেরল কমে যায় জমলে বা বেড়ে গেলে।
লেখক : চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক
ও বিজ্ঞান লেখক
লন্ডন, ইংল্যান্ড
[email protected]