ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

সচেতনতা থেকে শুরু হোক থ্যালাসেমিয়ামুক্ত ভবিষ্যৎ

সোহাইল আহমেদ, কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক ও সংগঠক

প্রকাশিত: ১৫:৪৬, ৭ মে ২০২৫

সচেতনতা থেকে শুরু হোক থ্যালাসেমিয়ামুক্ত ভবিষ্যৎ

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর ৮ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবস। এ দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো- থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এবং রোগীদের সহানুভূতির সঙ্গে গ্রহণ করা। এ বছরের থিম হোক- “সচেতনতা, প্রতিরোধ, মানবতা”। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ বাড়ছে মূলত সচেতনতার অভাবেই। অথচ একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এই জিনগত রোগটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তরোগ, যা বাবা-মায়ের মাধ্যমে সন্তানের দেহে প্রবেশ করে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেহে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন বিঘ্নিত হয়। ফলে শরীর প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায় না, দুর্বলতা দেখা দেয় এবং রক্তস্বল্পতা তৈরি হয়। যারা গুরুতর আক্রান্ত, তাদের প্রতি মাসে রক্ত নিতে হয়-যাকে বলে রক্ত-নির্ভর থ্যালাসেমিয়া অন্যদিকে বাহকরা রোগে আক্রান্ত না হলেও গোপনে জিনটি বহন করেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।

গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এই বাহকেরা যদি একে অপরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তবে তাঁদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ। এই একটি কারণেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।

প্রতিরোধই এই রোগের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বিয়ের আগে তরুণ-তরুণীদের থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করতে উৎসাহিত করা উচিত। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। এমনকি বিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে, যাতে কিশোর-কিশোরীরা আগেই এ বিষয়ে সচেতন হতে পারে।

চিকিৎসার দিক থেকে বলতে গেলে, থ্যালাসেমিয়ার একমাত্র স্থায়ী চিকিৎসা হলো ‘বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট’ বা হাড়ের মজ্জা প্রতিস্থাপন। এটি ব্যয়বহুল এবং জটিল প্রক্রিয়া, যা বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে কার্যকর। আরেকটি সম্ভাবনাময় পদ্ধতি হলো ‘জিন থেরাপি’, যা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ফলে অধিকাংশ রোগীকেই নিয়মিত রক্ত নিতে হয়, সঙ্গে আয়রন চেলেটিং থেরাপি চলতে থাকে। এসব চিকিৎসার খরচ অনেক পরিবার বহন করতে পারে না। এতে করে অনেক সময় শিশুর জীবন হুমকির মুখে পড়ে।

থ্যালাসেমিয়া শুধু একজন রোগীর ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জ। একজন রোগীর জন্য প্রতিমাসে রক্ত সংগ্রহ, চিকিৎসা খরচ, স্কুলে যাওয়া আসা, মানসিক চাপ সব মিলিয়ে পরিবারটির স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি সমাজে এই রোগ নিয়ে কুসংস্কারও কম নয়, ফলে রোগীরা নানা ধরনের বৈষম্য ও অবহেলার শিকার হন।

এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবস আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়, রোগ হলে চিকিৎসা নয়, রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধই হোক অগ্রাধিকার। সরকারিভাবে ব্যাপক প্রচারণা, রক্ত স্ক্রিনিং কার্যক্রম, থ্যালাসেমিয়া শনাক্তকরণ ক্যাম্প, এবং উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য বিশেষ চিকিৎসা ফান্ড গঠন এবং ওষুধের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

অবশেষে বলা যায়, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য ও পারিবারিক সচেতনতা। একটি রক্ত পরীক্ষা, একটি সচেতন সিদ্ধান্ত- একজন শিশুর জীবন রক্ষা করতে পারে। আজকের এই আন্তর্জাতিক দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক- নিজে সচেতন হবো, অন্যকে সচেতন করবো, আর থ্যালাসেমিয়ার ভবিষ্যৎ বন্ধ করবো।

মিরাজ খান

×