
ছবি: জনকণ্ঠ
চট্টগ্রামের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, ইতিহাস ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধনে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনন্য স্থাপত্য—আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। মোঘল সাম্রাজ্যের চিহ্ন বহনকারী এই প্রাচীন মসজিদ শুধু একটি ইবাদতের স্থান নয়, চট্টগ্রামের মুসলিম সমাজের হৃদয়ের স্পন্দন। প্রতি শুক্রবার এই মসজিদে জড়ো হন হাজারো মানুষ—শুধু চট্টগ্রাম শহর থেকে নয়, আসে ফটিকছড়ি, বাঁশখালী, রাউজান এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও। কারণ, এই মসজিদ মানুষের কাছে শুধুই একটি ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, এটি আবেগ, ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক।
ইতিহাসের গহীনে মোঘল চিহ্ন ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খাঁ'র পুত্র উমেদ খাঁ চট্টগ্রাম বিজয়ের পর, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ১৬৬৭ সালে নির্মিত হয় আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। কেল্লার ভিতরে নির্মিত হওয়ার কারণে এর নাম হয় ‘আন্দরকিল্লা’। শুরুর দিকেই মসজিদটি ইসলামি শিক্ষা ও সমাজজীবনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এমনকি মসজিদের প্রথম দিককার ইমামরা ছিলেন মদিনা শরীফ থেকে আগত আওলাদে রাসূল (রাঃ)।
ঐতিহাসিক ধ্বংস ও পুনর্জন্ম ১৭২৩ সালে নবাব ইয়াসিন খাঁ ‘কদম-রসূল’ সংরক্ষণের জন্য কাছাকাছি আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করায় কিছুদিনের জন্য এই মসজিদের গুরুত্ব হ্রাস পায়। ১৭৬১ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটিকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। তবে ১৮৮৫ সালে ঐতিহাসিক হামিদুল্লাহ খাঁ'র উদ্যোগে মসজিদটি মুসলমানদের জন্য পুনরায় উন্মুক্ত হয়।
মসজিদটি স্থাপিত হয়েছে সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু এক পাহাড়ের ওপর। এটি ১৮ গজ দীর্ঘ, ৭.৫ গজ প্রশস্ত, এবং দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ২.৫ গজ। পশ্চিম দেয়াল মাটির তৈরি, অন্য তিনটি পাথরের। একটি বড় ও দুটি ছোট গম্বুজবিশিষ্ট ছাদের নিচে ছায়া করে রেখেছে প্রার্থনার এক অনন্ত চিত্র। পূর্বে তিনটি, উত্তরে ও দক্ষিণে একটি করে মোট পাঁচটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। বিশেষভাবে বলা চলে, দিল্লির জামে মসজিদের আদলে নির্মিত এই মসজিদকে স্থানীয়রা ভালোবেসে ‘জামে সঙ্গীন’ বা পাথরের মসজিদ বলেও ডাকেন।
শুক্রবার মানেই আন্দরকিল্লা অভিমুখে মানুষের ঢল প্রতি শুক্রবার আন্দরকিল্লা মসজিদ হয়ে ওঠে মানুষের স্রোতের কেন্দ্র। সকাল থেকেই মানুষ আসতে থাকে দূরদূরান্ত থেকে। কারও হাতে জায়নামাজ, কারও কাঁধে ছোট বাচ্চা, কারও মুখে সুরা ইয়াসিনের আওয়াজ—মসজিদ চত্বরে নেমে আসে এক আত্মিক উৎসব। বিশেষ করে পবিত্র মাহে রমজানের শেষ জুমায় মসজিদটি রূপ নেয় এক বৃহৎ তীর্থস্থানে। মানুষ আসে কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান থেকেও।
রোজা ও ঈদের চাঁদ দেখার ঐতিহ্যবাহী ‘ফয়সালা’ কেন্দ্র চট্টগ্রামের বহু পুরোনো রেওয়াজ অনুযায়ী, রোজা শুরু ও ঈদের চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে আন্দরকিল্লা মসজিদের সিদ্ধান্ত ছিল নির্ধারক। মসজিদের খতিবদের দেওয়া ঘোষণা চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ মান্য করত বিনা প্রশ্নে। এটি এই মসজিদের প্রতি মানুষের অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের প্রমাণ।
এই মসজিদের প্রবেশপথে রয়েছে কালো পাথরের ওপর সাদা অক্ষরে খোদাই করা ফারসি শিলালিপি, যার বঙ্গানুবাদ—"হে জ্ঞানী, তুমি জগতবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় ২য় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে..."। এটি শুধু মসজিদের ধর্মীয় গুরুত্ব নয়, বরং তার স্থাপত্য, শৈল্পিকতা ও ঐতিহাসিক মূল্যকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ চট্টগ্রামের এক স্থাপত্য-প্রতীক, যার ভেতরে রয়েছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও মানুষের আত্মিক সম্পর্কের অদৃশ্য সেতুবন্ধ। এটি শুধু একটি প্রাচীন মসজিদ নয়—এটি চট্টগ্রামের মুসলমানদের চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। যেখানে মানুষ একত্রিত হয় নামাজের জন্য, আবার খুঁজে পায় এক টুকরো ইতিহাসের ছায়া।
সাব্বির