ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২

কেন পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি ঘুমের প্রয়োজন? 

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ২১ জুলাই ২০২৫

কেন পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি ঘুমের প্রয়োজন? 

ছবিঃ সংগৃহীত

টিকটক বা ইনস্টাগ্রামের ওয়েলনেস বিষয়ক ভিডিওতে প্রায়ই বলা হয় যে মহিলাদের পুরুষদের থেকে এক থেকে দুই ঘণ্টা বেশি ঘুমের প্রয়োজন হয়। কিন্তু গবেষণা কি সত্যিই তাই বলছে? এবং বাস্তব জীবনে এটি কেমন প্রভাব ফেলে?

গবেষকরা সাধারণত ঘুম পরিমাপ করেন দুইভাবে: এক হলো মানুষদের নিজের থেকে কতক্ষণ তারা ঘুমায় সেটা জিজ্ঞাসা করা (self-reporting), আর অন্য হলো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার, যেমন উচ্চমানের ওয়্যারেবল স্লিপ ট্র্যাকার বা পলিসমনোগ্রাফি, যা মস্তিষ্কের তরঙ্গ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং ঘুমের গতি রেকর্ড করে।

এই ধরনের গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, মহিলারা পুরুষদের তুলনায় গড়ে প্রায় ২০ মিনিট বেশি ঘুমান। এক বৈশ্বিক গবেষণায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বয়সের যেকোনো ধাপে মহিলাদের ঘুমের সময় পুরুষদের থেকে সামান্য বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ৪০-৪৪ বছর বয়সী মহিলারা পুরুষদের থেকে প্রায় ২৩ থেকে ২৯ মিনিট বেশি ঘুমান।

অন্য একটি পলিসমনোগ্রাফি গবেষণায় মহিলারা গভীর ঘুমের সময়েও পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে, রাতের মোট ঘুমের প্রায় ২৩ শতাংশ গভীর ঘুমে কাটায়, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে মাত্র ১৪ শতাংশ। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে পুরুষদের ঘুমের মান কমে যায়, কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে তা তেমন প্রভাব ফেলে না।

তবে এটি অবশ্যই লক্ষণীয় যে, প্রত্যেকের ঘুমের প্রয়োজন আলাদা। মহিলারা গড়ে সামান্য বেশি ঘুমায় ঠিক যেমন তারা গড় উচ্চতায় সামান্য ছোট হয়। তাই সবাইকে এক নির্দিষ্ট সময় ঘুমাতে হবে এমন নয়।

অন্যদিকে, মহিলারা ঘুমের মান খারাপ বলেই অনুভব করেন এবং নিদ্রাহীনতার (ইনসমনিয়া) রোগ নির্ণয়ের ঝুঁকিও পুরুষদের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। এই অসামঞ্জস্যতা ঘুম গবেষণায় একটি পরিচিত জটিলতা।

এর পেছনে রয়েছে নানা কারণ। অনেক গবেষণায় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, ওষুধ, মদ্যপান এবং হরমোন পরিবর্তনের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয় না, যা বাস্তব জীবনের ঘুমের সমস্যার মূল উপাদান।

জীববৈজ্ঞানিক দিক থেকে দেখলে, ঘুমের সমস্যা পিউবার্টির সময় লিঙ্গভিত্তিকভাবে পৃথক হয়ে শুরু হয়। গর্ভধারণ, সন্তানের জন্মদানের পর এবং পেরিমেনোপজে ঘুমের সমস্যা তীব্র হয়।

হরমোন, বিশেষ করে ঋতুস্রাবের আগে ও পেরিমেনোপজের সময় এই পার্থক্যের কারণ হতে পারে। ঋতুস্রাবের পূর্ববর্তী সময়ে যেহেতু ওএসট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন কমতে থাকে, অনেক মহিলা তখন ঘুমের সমস্যায় ভুগেন। পেরিমেনোপজে ওএসট্রোজেন কমার ফলে রাতের মাঝামাঝি সময়ে ঘুম ভেঙে যায় এবং পুনরায় ঘুমাতে সমস্যা হয়।

কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন থাইরয়েড সমস্যা এবং রক্তের লৌহের ঘাটতি মহিলাদের মাঝে বেশি দেখা যায়, যা ক্লান্তি ও ঘুমের ব্যাঘাতের জন্য দায়ী।

মনোবৈজ্ঞানিক দিক থেকেও মহিলারা বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং ট্রমা সম্পর্কিত রোগে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যা ঘুমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। চিন্তা-ভাবনার কারণে ঘুম ভেঙে যাওয়ার প্রবণতাও মহিলাদের মাঝে বেশি। তারা পুরুষদের চেয়ে বেশি মানসিক ওষুধ গ্রহণ করেন, যা ঘুমের রুটিনকে প্রভাবিত করে।

সামাজিকভাবে মহিলাদের ওপর অপ্রতিদান কাজ এবং যত্নের দায়িত্ব অনেক বেশি, যা তাদের বিশ্রামের সুযোগ সীমিত করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মহিলারা পুরুষদের তুলনায় প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৯ ঘণ্টা বেশি অপ্রতিদান কাজ করেন।

তাই ঘুমের সময় কম হলেও, দিনের বেলায় বিশ্রামের সুযোগ খুবই কম থাকে। ক্লান্তি শুধু ঘুমের অভাবে নয়, অনেক সময় অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যা, মানসিক চাপ এবং নিজেদের ওপর অতিরিক্ত প্রত্যাশার কারণে হয়।

বিশেষ করে মহিলারা প্রজননকালীন সময় রক্তের লৌহ ঘাটতির কারণে ক্লান্তি অনুভব করেন। এই সময়টাই তারা সন্তান পালন ও মানসিক চাপ সামলানোর সঙ্গে ব্যস্ত থাকেন।

পেরিমেনোপজে অনেক মহিলা কর্মজীবন, কিশোর সন্তান ও বৃদ্ধ পিতামাতার যত্নের পাশাপাশি রাতের মাঝামাঝি সময়ে ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং গরম ঝাঁপ নিয়ে লড়াই করেন। যদিও তারা পর্যাপ্ত বা ভালো ঘুমাতে পারেন, তবুও তারা সকালে সতেজ বোধ করেন না।

অতিরিক্তভাবে, বেশিরভাগ গবেষণাই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে না, ফলে ঘুমের ওপর বায়োলজি ছাড়াও পরিচয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব বুঝতে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়।

অতএব, মহিলারা গবেষণাগারে কিছুটা বেশি এবং ভালো ঘুমান, কিন্তু বাস্তব জীবনে তারা পূর্ণ বিশ্রাম পান না। ঘুমের দৈর্ঘ্য নিয়ে নাড়িয়ে দাওয়া নয়, বরং মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ ও সহায়তা দরকার।

সূত্রঃ www.ndtv.com

নোভা

×