ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কালের বিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি

হাবিবুর রহমান সুজন,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জাফলং, সিলেট

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ২৮ মে ২০২৫; আপডেট: ০৮:৫১, ২৮ মে ২০২৫

কালের বিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি

ছবিঃ সংগৃহীত

বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই- কুঁড়েঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে।’- কবি রজনীকান্ত সেনের লেখা অমর এই কবিতাটি নিশ্চই আপনার এখনো মনে আছে। কবিতাটি তৃতীয় শ্রেণিতে বাংলা পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকায় কবিতাটি পড়ে শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখি ও বাবুই পাখির শিল্পনিপুণতার কথা জানতে পারলেও বাবুই পাখির অস্তিত্বই যে আজ হুমকির মুখে।

ঐতিহ্যবাহী নিপুণ বাসা তৈরিতে দক্ষ কারিগর বাবুই পাখি ও এর বাসা এখন আর আগের মত চোখে পড়ে না। পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজার, নতুন বনায়নে বাসযোগ্য পরিবেশ ও খাদ্যের অভাব, নির্বিচারে তালগাছ কর্তন, অসাধু শিকারীর ফাঁদসহ বহুবিধ কারণে কালের আবর্তে প্রকৃতির স্থপতি, বয়ন শিল্পী এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি বাবুই পাখি ও এর দৃষ্টিনন্দন বাসা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। 

আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও গ্রাম-গঞ্জে ব্যাপক ভাবে বাবুই পাখির বাসা চোখে পড়ত। নিরীহ, শান্ত প্রকৃতির এই বাবুই পাখি উচু এবং নিরিবিলি পরিবেশে বাসা তৈরি করে। এরা গ্রাম-গঞ্জের তাল, সুপারি, নারিকেল, খেজুর গাছে বাসা তৈরি করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। এ সব গাছের সংকটে মাঝে মাঝে হিজল গাছেও বাসা বাঁধতে দেখা যায়। কিন্তু কালের বিবর্তনে বড় বড় গাছ নিধন ও পাখি শিকারের কারণে পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি। উঁচু তাল, নারিকেল ও খেজুর গাছে বাসা বাঁধলেও এ সব গাছ বিলুপ্ত হওয়ায় বাবুই পাখিও হারিয়ে যেতে বসেছে প্রকৃতি থেকে। 

এই পাখি বাসা তৈরির কাজে ব্যবহার করে খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কঁচি পাতা, ঝাউ ও কাঁশবনের লতা। চমৎকার আকৃতির এই বাসা বিশেষ করে তাল গাছের ডালে এমন ভাবে সাটানো থাকে যাতে কোনো ঝড়-তুফানে সহসাই ছিড়ে না পড়ে। এদের বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই নয়, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগায় এবং স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করে। ঠোট দিয়ে বাবুই পাখি আন্তর ছড়ায়। পেট দিয়ে ঘষে তা আবার মসৃণ করে। বাসা বানাতে শুরুতই দুটি নিম্নমুখী গর্ত করে থাকে। পরে তা একদিকে বন্ধ করে ডিম পাড়ার জায়গা করে। অন্যদিকে লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ তৈরি করে। ব্যালেন্স করার জন্য বাসার ভিতরে কাদার প্রলেপ দেয়। আধুনিক যুগে যা বড়ই যুক্তি সংগত। 

বাসার ভিতরে ঠিক মাঝখানে একটি আড়া তৈরি করে বাবুই পাখি। কি অপূর্ব বিজ্ঞান সম্মত চেতনাবোধ। ছোট হলেও বুদ্ধিতে সব পাখিকে হার মানায়। বাবুই ডিমে তা দেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। কৃষকের ধান ঘরে ওঠার মৌসুম হল বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। বাবুই পাখির বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই না, মানুষকে আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহ দেয়। 

কৃষ্ণনগর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি অলেক মিয়া বলেন- “গত কয়েক বছর ধরে তাদের গ্রামের কয়েকটি তালগাছে বাবুই পাখির বাসা দেখছেন। পাখি ও পাখির বাসা দেখতে এবং কিচির মিচির শব্দ শুনতে খুবই ভাল লাগে। গৃহিনী আসমা বেগম বলেন- তাদের বাড়ির সামনের তাল গাছে বাবুই পাখি বাসা বানিয়েছে। 

সাংস্কৃতিককর্মী  মাহমুদ জানান- দিন দিন তাল গাছ নিধনের ফলে বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। তাই বড় বড় তাল গাছ রক্ষা ও নতুন করে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পাখি সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি। 

সুর সম্রাট আলাউদ্দীন খাঁ ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, “সারাবিশ্বে বাবুই পাখির প্রজাতির সংখ্যা ১১৭টি। তবে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখির বাস। তিনি আরও বলেন- বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্য এরা জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে এবং সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। ধান, চাল, গম ও পোকা-মাকড় প্রভৃতি তাদের প্রধান খাবার। বাবুই পাখির জন্মগত ভাবেই শৈল্পিক দক্ষতা থাকে। কি ভাবে বাসা বাঁধবে এটা তারা তাদের মায়ের কাছ থেকেই শিখে নেয়। এই গুণ অন্য পাখির মধ্যে নেই। এরা সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করে বলে তাদের সামাজিক পাখিও বলা হয়। এরা শস্য দানা, ধান, গম ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে। 

তিনি বলেন, এ পাখির মধ্যে একটি বৈজ্ঞানিক গুণও আছে। পুরুষ পাখিরা বিশ্রামের জন্য বাসা বাঁধে আর নারী পাখিরা বাসা বাঁধে ডিম ফুটানো ও বাচ্চা সংরক্ষণের জন্য। যখন বাচ্চা ফোটার সময় হয় তখন মা পাখিরা এক টুকরা গোবর নিয়ে বাসায় রাখে। যাতে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে বাচ্চাদের ক্ষতি করতে না পারে”।

নোভা

×