ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জলবায়ু পরিবর্তন, বাস্তবতা আর অস্বীকৃতি

মোহাম্মাদ আল ইমরান, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১২:৫৮, ২৯ মে ২০২৫; আপডেট: ১৩:১৮, ২৯ মে ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তন, বাস্তবতা আর অস্বীকৃতি

ছবি:জনকন্ঠ

আধুনিক সমাজের বহু মাত্রিক সংকটগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জলবায়ু পরিবর্তন। যা শুধুমাত্র পরিবেশগত নয়, বরং  এই পরিবর্তন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সংকটের ও সৃষ্টি করছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন কেবল মাত্র বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামাজিক সিদ্ধান্ত, উন্নয়ন কৌশল এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার দ্বারাও প্রভাবিত। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি তীব্র হচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে এবং আবহাওয়ার চরম রূপগুলো নতুন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।

 

 

তাপ প্রবাহ, খরা, দাবানল, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি এবং সাইক্লোনও এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাড়িয়েছে। তাই জলবায়ু সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখন সহজ, সুস্পষ্ট এবং দৃশ্যমান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় মানুষের সক্ষমতার প্রশ্নে দুই মেরুতে অবস্থান বিশ্ব নেতাদের। 
যেমন- এ বছর মে মাসের শুরুতে চীনের জিয়মেনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এক শীর্ষ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলিকে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, চীনের পক্ষ থেকে আরও সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনকে স্বীকার করার পাশাপাশি সহায়তার কথাও জানান, তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন সংকটের মুখে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলির অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের দুর্বলতা চীন সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করে।” এই বক্তব্য শুধু চীনের ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ নয়, বরং এটি বৈশ্বিক জলবায়ু নীতির পদক্ষেপেরও একটি দৃষ্টান্ত।


তবে, জলবায়ু নীতিকে অগ্রাহ্য করে এমন শক্তিশালী একটি প্রতিপক্ষও আছে। বিগত বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে এই নীতিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। তার প্রশাসন প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির বরাদ্দ কমানো, এবং জীবাশ্ম জ্বালানির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে একপ্রকার জলবায়ু মোকাবেলা অস্বীকারের নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান বিশ্বে এক নতুন ধরনের পপুলিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যারা জলবায়ু নীতিকে ব্যয়বহুল ও অকার্যকর হিসেবে তুলে ধরতে ব্যস্ত।
অ্যান্ড্রে আরানহা কোরেয়া দো লাগো, ব্রাজিলীয় কূটনীতিক এবং পরিবেশ ও জলবায়ু নীতির ক্ষেত্রে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, বর্তমানে তিনি ২০২৫ সালের নভেম্বরে ব্রাজিলের বেলেম শহরে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন- COP30-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কোরেয়া দো লাগো আশঙ্কা করছেন যে, নতুন যে পপুলিজম সেটা প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে, জলবায়ু মোকাবেলার নীতিসমূহ অকেজো। তাই সে আহ্বান করেন যে, এখন যারা জলবায়ুনীতির উপর বিশ্বাস রাখছে তাদেরকেই মূলত প্রমাণ করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব এবং যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করতেও সক্ষম। 


তিনি আরও বিশ্বাস করেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, অর্থনৈতিক তত্ত্ব গুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আমরা যদি এই জলবায়ুনীতির যথাযথ প্রয়োগে অপারগ হই তাহলে এর বিপরীত একটাই, আর তা হচ্ছে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন নিকট ভবিষ্যতে আরো তিব্রতর ও ভয়ানক আকার ধারন করবে। কোরেয়া দো লাগো মনে করেন এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক অস্বীকৃতি অসম্ভব। কিন্তু আশংকা করেছেন যে জলবায়ুর পরিবর্তনের এই নতুন বিরোধিতা- বৈজ্ঞানিক অস্বীকার নয়, বরং অর্থনৈতিক অস্বীকার। তাই, এখন প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা জলবায়ু নীতিকে কেবল পরিবেশগত নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণের একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করবে। এখন সময় এসেছে সেই প্রমাণ হাজির করার,  জলবায়ুর বিরুদ্ধে লড়াই করাও সম্ভব, এবং তা আমাদের উন্নয়ন কেও গতিশীল করতে পারে।


সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন কেবলমাত্র একটি পরিবেশগত সংকটই নয়, বরং এটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বলেও বিবেচ্য,  যা আমাদের বৈষম্যমূলক বিশ্বব্যবস্থার প্রতিফলন। বর্তমান সময়ে জলবায়ুর বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা নিয়ে দ্বিমতের মূল ভিত্তি হচ্ছে— অর্থনৈতিক স্বার্থ। অ্যান্ড্রে কোরেয়া দো লাগোর উল্লিখিত ‘অর্থনৈতিক অস্বীকৃতি’ ধারণা বিশ্ব জলবায়ু রাজনীতির বর্তমান প্যারাডাইমের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা । এই প্রেক্ষিতে, টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ুর ন্যায্যতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কাঠামোগত রূপান্তর। এই পরিবর্তন আমাদের শুধু পরিবেশগত সুরক্ষা নয়, বরং সামাজিক সাম্য, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার এবং আন্তঃপ্রজন্মীয় দায়িত্ববোধকে অগ্রাধিকার দেয়।
 

আঁখি

×