ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চোখের সামনে বিলুপ্ত হচ্ছে জীবন্ত ফসিল! সাগরের এই নিঃশব্দ যোদ্ধার শেষ দিন কি সামনে?

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২৬ মে ২০২৫; আপডেট: ১০:১১, ২৬ মে ২০২৫

চোখের সামনে বিলুপ্ত হচ্ছে জীবন্ত ফসিল! সাগরের এই নিঃশব্দ যোদ্ধার শেষ দিন কি সামনে?

২৩ মে বিশ্ব কচ্ছপ দিবস। এ দিনটি শুধু উদ্‌যাপনের উপলক্ষ নয়, বরং তা একটি সতর্ক সংকেতও বটে।একটি আহ্বান, যাতে আমরা থেমে দেখি, শিখি এবং ভাবি: এই পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন জীব কচ্ছপদের আমরা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি?

২০০০ সালে আমেরিকান টরটয়েজ রেসকিউ নামক সংস্থার হাত ধরে যাত্রা শুরু করা এই দিবসটি মূলত কচ্ছপ ও কচ্ছপজাত প্রাণীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের দিন। এরা এক বিশাল ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য-২০ কোটিরও বেশি বছরের অস্তিত্বের ধারক। সাগরের তলে ধীর গতিতে সাঁতরানো হোক কিংবা বনজ জঙ্গলে ধীরে ধীরে হেঁটে চলা, প্রতিটি কচ্ছপ যেন প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এক নীরব সৈনিক।

কচ্ছপ দিবসের তাৎপর্য
কচ্ছপরা কখনো কোলাহল করে না, ঝাঁকে ঝাঁকে দৌড়ায় না। তবুও, তাদের নিঃশব্দ পদচারণা গোটা এক পরিবেশব্যবস্থাকে সচল রাখে। সামুদ্রিক কচ্ছপ ঘাস খায়, তা নিয়ন্ত্রণে রাখে, যাতে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ভারসাম্য বজায় রাখে। তারা জেলিফিশ খেয়েও সাগরের প্রাণীজগতের ভারসাম্য রক্ষা করে।

মিঠা পানির কচ্ছপরা যেন প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী। মৃত গাছপালা বা মাছ খেয়ে তারা পুকুর ও নদী পরিষ্কার রাখে। মরুভূমিতে টরটয়েস প্রজাতির কচ্ছপরা গর্ত খুঁড়ে আশ্রয় নেয়।যেখানে আশ্রয় পায় আরও বহু প্রাণী: খরগোশ, কীট, সরীসৃপ।তাদের ভূমিকা একেবারেই স্পষ্ট-যতক্ষণ তারা আছে, বাস্তুতন্ত্র সচল। কিন্তু তারা হারিয়ে গেলে? গাছপালা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে ওঠে, জল দুষিত থাকে, আর গরমে লুকোবার স্থানও থাকে না।

তারা হয়তো ধীরে চলে, কিন্তু তাদের প্রভাব প্রবাহিত হয় গোটা খাদ্যচক্রে। এক কচ্ছপের মৃত্যু মানেই শুধু একটি প্রাণীর বিলুপ্তি নয়, একটি ভারসাম্যের পতন।এই প্রাণীরা কান্না করতে পারে না। তারা চিৎকার করে না যখন মাছ ধরার জালে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদ করে না যখন তাদের জন্মস্থান সৈকত দখল হয়ে যায় হোটেল-রিসোর্টে।

অনেক কচ্ছপ হাজার হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ শেষে ফিরে আসে সেই সৈকতে, যেখানে তাদের জন্ম। কিন্তু এখন সেই স্থান হয়তো দূষিত, জনাকীর্ণ বা একেবারে বিলীন।অনেকে রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়। কেউ আবার বন্যপ্রাণী থেকে তুলে নিয়ে পোষা প্রাণী বানিয়ে ফেলে। কিছু খেয়ে ফেলে, কিছু নিখোঁজ হয়ে যায়।

সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু? প্লাস্টিক। ভেসে থাকা ব্যাগকে তারা জেলিফিশ ভেবে খেয়ে ফেলে। পেট ভর্তি হলেও পুষ্টি না থাকায় তারা ধুঁকে ধুঁকে মরে।

 

ধীর গতির জীবনে লুকিয়ে থাকা শিক্ষা
বিশ্ব কচ্ছপ দিবস আসলে কচ্ছপ দেখার আহ্বান, শুধু প্রশংসার নয়। আমরা যখন দ্রুত স্ক্রল করি, সোয়াইপ করি, তখন হারিয়ে ফেলি এই ধীর জীবনের সৌন্দর্য।
কচ্ছপদের জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয় ধৈর্য, স্থিরতা ও অধ্যবসায়। ২০ কোটিরও বেশি বছর ধরে তারা টিকে আছে জোরে নয়, ধৈর্যে।

একটি স্কুল ভ্রমণ, একটি ডকুমেন্টারি, বা একটি নবজাত কচ্ছপের সাগরের দিকে এগিয়ে চলা।এই মুহূর্তগুলো শিক্ষা দেয়, যে জীবনের মূল্য ছোট ছোট বিষয়েই।কচ্ছপদের জন্য কিছু করতে হলে বিজ্ঞানী হতে হয় না। দরকার কেবল সচেতনতা। রাস্তা পার হতে গিয়ে অনেক কচ্ছপ মারা যায়। আপনি যদি চালকের আসনে থাকেন, গতি কমান। নিরাপদে পার করে দিন কচ্ছপটিকে, সেই দিকেই যেদিকে সে যাচ্ছিল।

পুকুর, নদী, বা সৈকতের পাশ থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করা একটি প্যাকেট তুলেই হয়তো বাঁচাতে পারেন একটি প্রাণ।পোষা প্রাণী হিসেবে কচ্ছপ কেনা বা কাউকে কেনার পরামর্শ দেওয়া এটা ঠেকাতে বলুন। কারণ কাঁচের ট্যাংকে কখনোই প্রকৃতির অনুরূপ পরিবেশ তৈরি হয় না।

কেউ কেউ এই দিনে সবুজ পোশাক পরে সচেতনতা ছড়ায়, কেউ চিত্র আঁকে ফুটপাতে, কেউ পোস্ট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য ও বার্তা।শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে কচ্ছপ থিমের বই, হ্যান্ডক্রাফট বা গল্প নিয়ে আসেন। এগুলো ছোট হলেও ফলপ্রসূ।কচ্ছপরা মুখ খুলে কিছু বলে না। কিন্তু তাদের অস্তিত্বই এখন বিপন্ন। তাই এই ছোট ছোট প্রয়াসই প্রয়োজন।

কিছু চমকপ্রদ তথ্য
কচ্ছপরা ডাইনোসরের যুগ থেকেও পুরনো। প্রাকৃতিক বাছাইয়ের নিখুঁত উদাহরণ তারা। জল ও স্থল দুই পরিবেশেই বাস করে কচ্ছপেরা।

তাদের খোলস কোনো বর্ম নয়, বরং কচ্ছপের শরীরের অংশ ৫০টিরও বেশি হাড় দিয়ে গঠিত। তারা কখনোই খোলস থেকে বের হতে পারে না।

সামুদ্রিক কচ্ছপ পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে দিক নির্ধারণ করে, হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়েও ফিরে আসে জন্মস্থান সৈকতে।

তাদের দাঁত নেই, কিন্তু ঠোঁট শক্তিশালী। কিছু কিছু কচ্ছপ ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।


কচ্ছপরা অতীতে আটকে নেই, কিন্তু অতীত তাদের শরীরে লেখা। আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, মহাদেশের স্থানচ্যুতি, এমনকি বিলুপ্তির ঝড় সবই তারা পার করেছে।তারা এসেছে আমাদের আগেই, এবং এখনও তারা আমাদের চারপাশে। ধীরে ধীরে হাঁটে, সাগর পাড়ি দেয়, ইতিহাস বহন করে পিঠে।কিন্তু চিরন্তন এই প্রাণীরা আজ আমাদের সহায়তা ছাড়া টিকে থাকতে পারছে না। প্রকৃতি সবসময় তার প্রাচীনতম সন্তানদের রক্ষা করে না। অনেক সময় মানুষও ভুলে যায় তাদের।

এই কারণেই বিশ্ব কচ্ছপ দিবস এতটা জরুরি। এটি কেবল অতীতের শ্রদ্ধা নয়, বর্তমানের অঙ্গীকার। এটি একটি প্রতিশ্রুতি আমরা তাদের দেখছি, তাদের গুরুত্ব দিচ্ছি, এবং তাদের টিকে থাকার জন্য পাশে থাকব।আমাদের কর্মই ঠিক করবে কচ্ছপদের ভবিষ্যৎ। আজ যদি আমরা সচেতন হই, তবে আগামী শতাব্দীতেও তারা পৃথিবীর পথে ধীর গতিতে হাঁটবে, পিঠে বয়ে বেড়াবে এক গৌরবময় ইতিহাস।

 

 

 

সূত্র:https://tinyurl.com/3ppkusb6

আফরোজা

×