ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ছয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নেবে সরকার

আমানতকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ গভর্নরের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৫৮, ২৭ মে ২০২৫

আমানতকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ গভর্নরের

ছয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নেবে সরকার

অবশেষে দুর্বল ও অনিয়মে জর্জরিত হয়ে পড়া ইসলামী ধারার ৫টিসহ মোট ছয়টি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সরকার অস্থায়ীভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, একীভূতকরণের আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ওপর সরকার মালিকানা প্রতিষ্ঠা করবে। এতে আমানতকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ তারা একটি অধিকতর শক্তিশালী ব্যাংকের অংশ হয়ে যাবেন। 
গভর্নর আরও বলেন, আমি আমানতকারীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা আতঙ্কিত হয়ে টাকা উত্তোলনের পথে না যান। সরকার যেহেতু এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, তাদের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। তিনি জানান, ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক রেজল্যুশন ফান্ড’ গঠণের জন্য তহবিল সংগ্রহ শুরু করবে। পাশাপাশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করা হবে না বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।

সম্প্রতি ব্যাংক খাত নিয়ে সরকার একটা অধ্যাদেশ জারি করেছে। মূলত সেই অধ্যাদেশের আলোকেই সরকার স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী বাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সংকট দূর করার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণে নিবে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট আর ঋণ জালিয়াতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের ওপর মহলের সহযোগিতায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণের নামে ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। বিশেষ করে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে লুটপাট বেশি হয়েছে।

এসব লুটপাটের কারণে বেশ কয়েকটা ব্যাংক চরম তারল্য সংকটে পড়ে। ব্যাংকগুলো দুর্বল হতে হতে একটা পর্যায়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিগত সরকারের আমলে অতি দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছিল লুটপাটে সহায়তাকারী গভর্ণর আব্দুর রউফ তালুকদার। দফায় দফায় মিটিং এবং দুয়েকটি ব্যাংকের মধ্যে প্রাথমিক চুক্তি হওয়ার পরও এ উদ্যোগ আর সামনে বাড়েনি। এরই মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাটের কারণে ধসে পড়া আর্থিক খাত সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করে নতুন সরকার।
এদিকে ধসে পড়া ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠন করা হয় কয়েকটি টাস্কফোর্স। টাস্ক ফোর্সগুলো বিভিন্ন ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখছেন। অপরদিকে ৫ আগস্টের পর গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আত্মগোপনে চলে গেলে ড. আহসান এইচ মনসুরকে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। নতুন গভর্নর প্রথমে বলেছিলেন কোনো ব্যাংকে আর তারল্য সহায়তা দেওয়া হবে না। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংকের আমানতকারীরা এসে ব্যাংকের সামনে টাকার জন্য আন্দোলন শুরু করলে আবার ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রাথমিকভাবে আন্তঃব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা কার্যকর হয়নি। ফলে ২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছয়টি ব্যাংকে মোট ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসআইবিএলকে ৫ হাজার ৫০০ কোটি এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক ৫ হাজার কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংক ২ হাজার কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার কোটি, এক্সিম ব্যাংক ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পেয়েছে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এভাবে তারল্য সহায়তা দিয়ে ব্যাংকগুলোকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। হয়তো ব্যাংকের সংখ্যা কমাতে হবে নয়তো এগুলো মার্জার করতে হবে। সম্প্রতি দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে সরকার একটা অধ্যাদেশও জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে সরকার চাইলে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে। এছাড়া গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও একাধিকবার বলেছেন যে প্রয়োজনে ব্যাংক মার্জার হতে পারে। সর্বশেষ গত সোমবার বেসরকারি একটা টিভি চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারকে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই অতিদুর্বল হয়ে পড়া ৬টি ব্যাংকে সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এগুলোকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হবে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আসছে জুলাইয়ের মধ্যে এসব ব্যাংকগুলোকে সরকারি মালিকানায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পুঁজি যোগান দেওয়া হবে। এরপর ভিত্তি শক্ত হওয়ার পর বিদেশি বিনিয়োগকারী খোঁজা হবে। দুর্বল ৬ ব্যাংক হলো-সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, এক্সিম ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড।

×