
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর
ছাত্র-জনতার অভ্যুথানের মাধ্যমে গত বছরের আগস্ট মাসে হাসিনা ও তার দলের অনেক নেতা পালিয়ে দেশ ত্যাগ করে। এরপর শ্বেতপত্র কমিটি হাসিনা সরকারের দুর্নীতির পরিমাণ প্রকাশ করে। আ’লীগ গত ১৫ বছরে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্য প্রকাশ করেন।
এবার অর্থপাচার প্রতিরোধে সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশ থেকে ১৮–২০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে (বাংলাদেশি টাকায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা)। একজনই ৩৫০টি বাড়ি কিনেছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এসব অর্থপাচার করা হয়েছে। এসব ঘটনা উদ্ঘাটন করা গেছে। দিন দিন এই অর্থের পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএফআইইউএর প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা এএফএম শাহীনুল ইসলাম।
অনুষ্ঠনের প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পাচারের অর্থ ফেরত আনতে হবে, এ ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য নতুন। আমরা কেউ এ ধরনের কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। পাচারের অর্থ ফেরত আনার কাজ গতিশীল করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সে জন্য আইনে পরিবর্তন আনা হবে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে।’
গভর্নর আরও বলেন, ‘পাচারের অর্থ ফেরত আনতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে। ইতোমধ্যে বিদেশে একজনের সম্পদ জব্দ হয়েছে। সামনে আরও সম্পদ জব্দ হবে। আমাদের উদ্দেশ্য, পাচারকারীদের ওপর চাপ তৈরি করা, যাতে আদালতের বাইরে গিয়ে অর্থ উদ্ধার করা যায়। কাউকে জেলে নিয়ে হয়রানি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কারও ব্যবসা বন্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কারও ব্যবসা বন্ধ করিনি। যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, অন্য কারণে তা হয়েছে।’
বিএফআইইউর প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলাম বলেন, অর্থপাচার ও হুন্ডি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও লেনদেন ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্রবণতা। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কাজ চলছে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে। এ কাজে পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক।
বিএফআইইউর প্রধান বলেন, পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার লক্ষ্যে সংস্থাটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, তদন্তকারী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। বিশ্বব্যাংকের এসটিএআর, যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডোজ, আইএসিসিসি ও আইসিএআরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল হওয়ায় সময় লাগবে।
সভায় বিএফআইইউর পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, অর্থপাচার ধরা ও উদ্ধার করা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা চলতেই থাকবে। গত বছরের জুলাই মাসের পর বিএফআইইউর কাজ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সন্দেহজনক প্রতিবেদন অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন পাঠানো চার গুণ বেড়েছে।
ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানিসহ রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টিং (এসটিআর) বেড়েছে। সভায় জানানো হয়, চলতি অর্থবছরে বিএফআইইউতে মোট ১৭ হাজার ৩৪৫টি সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম-সংক্রান্ত প্রতিবেদন (এসটিআর/এসএআর) দাখিল হয়েছে; আগের বছরের তুলনায় যা প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। এতে বোঝা যায়, অর্থপাচার প্রতিরোধ কার্যক্রমে প্রতিবেদন প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সচেতনতা ও দক্ষতা বেড়েছে।
এ ছাড়া বিএফআইইউ গত অর্থবছরে ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ মোট ১ হাজার ২২০টি তথ্য বিনিময়ও হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি। মূলত জুলাই বিপ্লবের পর এ ধরনের রিপোর্টিং ব্যাপক বেড়েছে। ২০২২-২৩ এসটিআর ছিল ১৪ হাজার ১০৬টি।