
‘নগদ’ ডাক অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে
লাইসেন্সবিহীন মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ ডাক অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক দলের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি এখন ডাক অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে। প্রতিষ্ঠানটিতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক দ্বারা পরিচালনায় নগদের সবশেষ দৈনিক লেনদেন হয় ১৪৭০ কোটি টাকা। এর পরে একদিনও এর সমপরিমাণ লেনদেন করেনি নগদ। কিন্ত ১৭ মে নগদের দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা দাবি করে আগের তুলনায় এখন শতকোটি টাকা বেশি লেনদেন হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তির সূত্রমতে দৈনিক শত কোটি টাকার লেনদেনের বিস্তারিত কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। শুধু মাত্র সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে আস্থা ফেরাতে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় বলে জানা যায়।
ডাক অধিদপ্তর জানান, ডাক বিভাগের সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগির চুক্তির আওতায় থাকা নগদের দায়িত্বে নেওয়ার পর গ্রাহকদের মধ্যে অনেকটা ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডাক অধিদপ্তর নগদ-এর মাধ্যমে সবাইকে এমএফএস সেবা দিচ্ছে। ফলে গ্রাহকেরা কম খরচে ভালো সেবা গ্রহণের জন্য নগদের ওপর সবসময় আস্থা রেখেছেন। যার অংশ হিসেবে দৈনিক গড় লেনদেন ১০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত ১২ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন হাইকোর্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নগদ পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে প্রশাসক দল নগদে কাজ করছিল, তারা দায়িত্ব হারায়। এদিকে নগদের অর্থ তছরুপের জন্য যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তাদের মধ্যে একজনকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি হলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক মো. সাফায়েত আলম। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নিয়ে তিনি নতুন মানবসম্পদ কর্মকর্তা নিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে। জনকণ্ঠের হাতে আসা তথ্যমতে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায়ের ১৯ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলার আরও দুই আসামিকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে নগদ পরিচালনায় নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
নগদ জানান, গত আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদে প্রশাসক নিয়োগ করলে নিয়োগ প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে তখন উচ্চআদালতের দ্বারাস্থ হন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সাফায়েত আলম। গত সপ্তাহে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত নগদে প্রশাসক নিয়োগে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। ফলে নগদের আগের বোর্ডের নগদ পরিচালনায় কোনো বাধা থাকছে না।
এদিকে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেওয়া আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ১৯ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির দিন নির্ধারণ করার কথা থাকলেও তা ফের পেছানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রশাসক বসানোর পর বিশেষ নিরাক্ষায় দেখা যায়, নগদ লিমিটেডে বড় ধরনের জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না। হাসিনা সরকারের আমলে নিয়মের বাইরে গিয়ে গ্রাহক বানানো ও সরকারি ভাতা বিতরণসহ একচেটিয়া সুবিধা পায় নগদ। প্রতিষ্ঠানটিতে যখন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। এ ঘটনায় ২৪ জনকে আসামি করে মামলা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান নগদের হিসাব ব্যাংকগুলোতে যাদের স্বাক্ষরে পরিচালিত হয়, তা পরিবর্তন করতে পারবে না ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো নগদের হিসাব থেকে অর্থ লেনদেন করতে পারবে না। তবে নগদের নিয়মিত লেনদেন চলবে। নগদ পরিচালনায় নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর বাংলাদেশ ব্যাংক এই নির্দেশনা জারি করেছে। ব্যাংক লোন ও গ্রাহকের জমা করা অর্থ যাতে কোনোভাবে তছরুপের শিকার নয়, সে জন্য এই নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদ অল্প সময়ের ব্যবধানে জনপ্রিয়তা পায়। তারা লাইসেন্স না পেলেও প্রতিষ্ঠানের নামে দেশি-বিদেশি ডজন খানেক ছদ্মবেশী কোম্পানিতে বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে । তবে বিনিয়োগের টাকার কানাকড়িও আর দেশে ফেরেনি। চলে গেছে তৃতীয় কোনো দেশে। এভাবেই গেল ৮ বছরে দেশের লাখ লাখ গ্রাহকের আমানতের শত শত কোটি টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন নগদ সিন্ডিকেট।
এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতা ও তাদের অনুসারীরা। এমনকি নগদ অপকর্মে জড়িয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকারের সরকারি কর্মকর্তারাও। জড়িত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একজন উপ প্রেস সচিবও। অর্থ লুটপাটে জড়িত কেউ কেউ এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। পড়েনি কোনো আইনের গ্যাঁড়াকলেও। অভিযুক্তদের অনেকে আবার নগদকে ঢেলে সাজানোর সবক দিচ্ছেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, নগদের বর্তমান সিইও সাফায়েত হোসেন মামলার আসামি হওয়ার কারণে ১২ মে থেকে এখন পর্যন্ত একদিনও অফিস করেননি। ই-মেইল এর মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে অফিসের নির্দেশনা দিয়ে আসছে।
অফিস পরিচালনায় তিনি রাজনৈতিক পালস বুঝে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের পিও আতিক মোর্শেদের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা জুইকে নগদের কম্পøায়ান্স বিভাগের এ্যাসেসটেন্ট ম্যানেজার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার মাসিক সম্মানী এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা। তবে আতিক মোর্শেদ নগদের নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মাচারী না হলেও তিনি নিয়মিত নগদের অফিসে যাওয়া আসা করছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে প্রতিষ্ঠনটির বর্তমান এমডি মুইজ তাসনিম ত্বকীকে ১৮ মে বেইলি রোড থেকে ডিবি পুলিশ আটক করে ফোন ল্যাপট জব্দ করে রাখে। পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগের বিশেষ সহকারী তৈয়বের সুপারিশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হঠাৎ কেন তাকে তুলে নিয়ে গেল, এই বিষয়টি নিয়েও এক প্রকার ধূ¤্রজাল তৈরি হয়েছে।
নগদকে নিজেদের মত করে পরিচালনা করতে পদোন্নতি ও নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে নগদেই কর্মরত পুলিশের সাবেক এডিশনাল আইজিপি মো. মাহবুব আলমসহ আরও কয়েকজনকে অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার জন্য সম্মানী বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সাফায়াতের এপিএস ফকির বদির উদ্দিন আহমেদ, তার আত্মীয় গার্মেন্টেসের লাইনম্যান মো. ইমনকে নগদের মত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে নগদের পূর্বের অভিযুক্ত (আসামি) ব্যক্তিদের সকল ডেটা মুছে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে যারা কর্মরত রয়েছে তাদের মধ্যে বিশেষ করে আইটি বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া নির্দেশনা মতে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় কোনো লেনদেন করতে পারবে না। তারা পূর্বের মতো করে বিল-ভাউচার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমার আশঙ্কা, কোম্পানির নতুন ব্যবস্থাপনায় যারা রয়েছেন, তারা আগের অনিয়মের তথ্য মুছে ফেলতে পারেন। আমরা মনে করি তাদের (বর্তমান ব্যবস্থাপনা) হাতে নগদের কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত নয়। কোর্টের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা সেটার জন্য আপিল করেছি। এ বিষয়ে খুব দ্রুত শুনানি হবে। আমরা মনে করি, রায় আমাদের পক্ষে পাব।’
তিনি বলেন, আমরা শংকিত, কারণ এ সময়ের মধ্যে তারা সিস্টেমের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। তারা অনেক কিছু করে ফেলতে পারে, যেটার ওপর আমাদের কোনো হাত থাকবে না। তারা তাদের যে অপকর্মগুলো করেছে, তা মুছে ফেলার চেষ্টা করবে। ডেটাগুলোকে মুছে দেবে যা, পরবর্তীতে আমাদের কাজকে আরও কঠিন করে তুলবে। গভর্নর বলেন, নগদে আগের ম্যানেজমেন্ট ও বোর্ডে যারা ছিলেন, তারা নানা উপায়ে দুর্নীতি ও টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এদিকে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর অনিয়ম ধরতে ফরেনসিক নিরীক্ষা না করার নির্দেশনা চেয়ে দায়ের করা রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। রিট খারিজের ফলে নগদের দুর্নীতি তদন্তে ফরেনসিক অডিটে আর কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।
নগদের মালিকানার সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা যুক্ত। ফলে বিদায়ী সরকারের সময়ে কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাই এটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
নগদের আর্থিক অনিয়ম ও বর্তমান সময়ের দৈনিক লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে, নগদের বর্তমান সিইও সাফায়েত হোসেন সরাসরি নিজে প্রশ্নউত্তর না দিয়ে নগদের মিডিয়া বিভাগ থেকে জনকণ্ঠকে জানানো হয়, পরিবর্তনের সময়কালের মধ্যে নগদের লেনদেন দিনে ৯৪ কোটি টাকার বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সে কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে এক প্রেস রিলিজে প্রায় ১০০ টাকার লেনদেন বৃদ্ধি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নগদের পক্ষ থেকে প্রতিবেদককে আরও জানানো হয় অধিকতর তথ্য জানতে আপনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতি মাসে নগদ লিমিটেড বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদের লেনদেনের সার্বিক তথ্য প্রদান করে থাকে কিন্তু নগদের বর্তমান সিইও সাফায়েত হোসেন দায়িত্ব গ্রহণের পর কোনো তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া হয়নি তারা বিষয়টি গোপন রেখেছে। তিনি বলেন, নগদের দৈনিক লেনদেন পূর্বের চেয়ে ১০০ কোটি বেশি এই তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের জানা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক স্থগিতাদেশ রায়ের বিষয়ে তিনি জানান, উচ্চ আদালতে বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য আমরা দিতে পারি না। বিজ্ঞ আদালত যে রায় দেবে আমরা সেই রায়কে সম্মান জানাব।