
গবেষণার জন্য কোনো প্রস্তাব ছিল না
গবেষণার জন্য কোনো প্রস্তাব ছিল না। করা হয়নি কাঠামোগত যাচাই। যে বিষয়গুলো নির্বাচন করা হয়েছে তা একই ধরনের। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রযোজ্য হলেও মন্ত্রণালয়ের অনুমতিও পাওয়া যায়নি। উল্টো মন্ত্রণালয়ের টাকায় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার তিনটি গবেষণা করা হয়েছে। এভাবেই পৌনে ৬ কোটি টাকা আট গবেষণায় অর্থ ব্যয় করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। গবেষণাটি ছয় মাসে সম্পন্নের কথা থাকলেও তড়িঘড়ি করে মাত্র দুই মাসে করা হয়েছে। এতে গবেষণার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণাগুলো করেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) শিক্ষকরা। নিয়ম অনুযায়ী কমিটিতে ৩ সদস্য থাকা উচিত। কিন্তু নিয়ম ভেঙে ছিলেন ৯ জন। যে কারণে ব্যয় হয়েছে অতিরিক্ত অর্থ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের পতনের আগে গবেষণার কাজ দেওয়া হয়েছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক উত্তম কুমার দাশ। যিনি ৫ আগস্টের পর অফিস করেননি। চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি৪)-এর আওতায় বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় যেনতেনভাবে এই গবেষণা সম্পন্ন করায় মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে খোদ অধিদপ্তর। গবেষণার কাজে সম্পৃক্ত আইইআর গবেষকদের (শিক্ষক) বিল আটকে দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ বিষয়ে একটি তদন্ত করেছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গবেষণার বিষয়বস্তু প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া গবেষণাসমূহের বিষয় নির্ধারণের যৌক্তিকতা নিরূপণে দাপ্তরিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট আটটি গবেষণার মধ্যে দুই গবেষণা করেছে মাদ্রাসা শিক্ষা সংক্রান্ত। একটি গবেষণা কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাবহির্ভূত মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর পরিচালিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কোনো অনুরোধ পত্র মেলেনি এই প্রতিবেদনে। ৫ কোটি ৭৮ লাখ ২৯ হাজার টাকার এই গবেষণা কার্যক্রমে আইইআর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কোনো সভা-কর্মশালা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইইআর কর্তৃক গবেষণা প্রস্তাব প্রকিউরমেন্ট বিভাগে দাখিল করা হয়েছে। তাই প্রকিউরমেন্ট বিভাগ এ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান করতে পারবে। প্রকিউরমেন্ট বিভাগের বক্তব্য অনুযায়ী, বিষয়টি পিইডিপিও সংশ্লিষ্ট অর্থাৎ গবেষণা প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো প্রস্তাব পাওয়া যায়নি। গবেষণার টুলস বিশেষ করে গবেষণার প্রশ্নপত্র, ডাটা কালেকশন পদ্ধতি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে এমন কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট বিভাগ) মো. হামিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকিউরমেন্ট বিভাগ গবেষকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এখন তারা যদি গবেষণা না করেন, বা ৬ মাসের গবেষণা দুই মাসে করেন এগুলো তাদের বিষয়। আর বিল দেওয়ার দায়িত্ব অর্থ বিভাগের। সে কারণে গবেষণার বিষয়, সময় ও যৌক্তিকতা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।
গবেষণার বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। বিল না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিল পাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এটি নিয়ে অধিদপ্তর কাজ করছে। মাত্র দুই মাসে আট গবেষণা কিভাবে করা হলো এই প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি আমি বলতে পারব না। এটি বলবেন প্রফেসর শাহ শামীম আহমেদ। যিনি আমাদের স্পোকস পার্সন।
তবে আটটি উচ্চমূল্যের গবেষণা মাত্র দুই মাসে সম্পন্ন হওয়ায় আশ্চর্য হয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল।
জনকণ্ঠকে তিনি জানান, গবেষণার বিষয়, তার গভীরতাসহ আরও কিছু বিষয়ে এর মান ও খরচ জড়িত। যেটা শুনছি প্রায় ৬ কোটি টাকায় ৮ গবেষণা মাত্র দুই মাসে করা হয়েছে এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অর্থের বিচারে এমন একটি গবেষণা করতে অন্তত ৬ মাস সময় প্রয়োজন। আরও যে অসঙ্গতির কথা বলছেন তা বেশ আপত্তিজনক।
জানা যায়, ২০২৪ সালে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পিইডিপি৪) উত্তম কুমার দাশের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরএর মাধ্যমে আট গবেষণা সম্পাদনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। আইইআরকে সিঙ্গেল সোর্স পদ্ধতিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। আট গবেষণাগুলো হলোÑ স্টাডি অন ডেভেলপমেন্ট লিডারশিপ ট্রেনিং ফর হেড টিচার্স অব প্রি-প্রাইমারি এডুকেশন। স্টাডি অন ডিমান্ড অ্যাসেসমেন্ট ফর দ্য প্রি ইবতেদায়ী এডুকেশন ইন মাদ্রাসা।
স্টাডি অন দ্য ডেভেলপমেন্ট অব ট্রিচার্স ট্রেনিং কারিকুলাম অ্যান্ড সফট স্কিলস। স্টাডি অন নিডস অ্যাসেসমেন্ট অব লাইফ স্কিল ট্রেনিং ইন দ্য প্রাইমারি এডুকেশন, স্টাডি অন দ্য ডেভেলপমেন্ট এ লিডারশিপ ট্রেনিং ম্যানুয়াল ফর দ্য ইনস্টিটিউশনাল হেড অব মাদ্রাসা। ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর দ্য প্রি সার্ভিস টিচার এডুকেশন ফর প্রাইমারি টিচার। স্টাডি অন দ্য সিচুয়েশন এনালাইজ অব প্রাইমারি টিচার্স ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট, স্টাডি অন ইভালুয়েটিং দ্য অনগোয়িং রিমোট টিভিইট প্রোগ্রাম বাই ডিইটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, নিয়ম অনুযায়ী পিপিআর (১৬) (৫) (ক) (খ) অনুযায়ী ব্যয় নির্ধারণ কমিটি ৩ সদস্য বিশিষ্ট হবে। কিন্তু বিধি ভঙ্গ করে শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটকে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ সদস্য বিশিষ্ট মূল্য নির্ধারণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। যা নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়াও গবেষণা ব্যয় অনেক বেশি ধরা হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর দ্য প্রি সার্ভিস টিচার এডুকেশন ফর প্রাইমারি টিচার সংক্রান্ত গবেষণায় প্রতি মাসে তিন লাখ করে তিন মাসে ৯ লাখ। ছয় জনের জন্য প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকা হিসেবে তিন মাসে পঁয়তাল্লিশ লাখ টাকা এবং গবেষণা সহযোগীদের জনপ্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকাসহ মোট বাজেট এক কোটি সাতাশ লাখ সাতাশ হাজার দু’শ’ একান্নব্বই টাকা পঞ্চাশ পয়সা ধার্য করা হয়। যা অস্বাভাবিক হিসেবে বলছে অধিদপ্তর।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পিইডিপি৪) এর নেতৃত্বে অনুমোদন কমিটি থাকা সত্ত্বেও উক্ত কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত নয় প্রকিউরমেন্ট বিভাগ কর্তৃক সেবা ক্রয় অননুমোদিত। ফলে ছিয়াশি লাখ চুয়াত্তর হাজার তিনশ’ আশি টাকার বিল পরিশোধ করা বিধি পরিপন্থি। এ ছাড়াও প্রতিটি গবেষণা খুব তাড়াহুড়া করে সম্পন্ন করা হয়েছে। রিভিউ, টুলস উন্নয়ন, টুলস ভেলিডেশন, টুলস অবহিতকরণ, ডাটা কালেকশন, ডাটা ম্যানেজমেন্ট, ডাটা এন্ট্রি, ডাটা এনালাইসিসে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করা হয়নি। গবেষণায় আদর্শ গবেষণা কাঠামো অনুসরণ করা হয়নি। গবেষণা পরিচালনার পর সরাসরি চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে যা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ অন্যান্য সরকারি দপ্তর বা সংস্থাসমূহের গবেষণা নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আইইআর অধ্যাপক প্রফেসর শাহ শামীম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিল না দেওয়ার নেপথ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিশেষ করে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পিইডিপি-৪) জড়িত। মহাপরিচালক সিগনেটরি। তাবে অতিরিক্ত মহাপরিচালকই বেশি বেশি করছেন। তারা আমাদের মাত্র ১৫ শতাংশ কাজের টাকা দিয়েছেন। এখন কেন বিল দিচ্ছে না, এ বিষয়ে কোনো কিছুই বলছে না। একবার খরচের বিবরণী চেয়েছেন, আবার বিবরণীসহ ভাউচার চেয়েছেন। তারা বুঝতে চাইছে না প্রতিটি গবেষণায় প্রচার খরচ। শিক্ষার্থীরা এই গবেষণায় জড়িত ছিল তারাও টাকা পাচ্ছে না।
মাত্র দুই মাসে আট গবেষণা কিভাবে করা হলো এ বিষয়ে তিনি জানান, আমাদের আটটি দল এই কাজ করেছে। নভেম্বরের এক তারিখ থেকে ডিসেম্বরের শেষে আমরা প্রতিবেদন দাখিল করেছি। আমাদের চুক্তিও এমন ছিল। কিন্তু তারা কী কারণে বিল আটকে রেখেছে তার কিছুই বলছে না। এসব বিষয় জানিয়ে আমরা উপদেষ্টা ও সচিবকেও আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছি। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামানকে ফোন দেওয়া হলে তিনি ধরেননি। পিইডিপি-৪ এর অতিরিক্তি মহাপরিচালক মোহাম্মদ আকিকুর রহমানকে একাধিক বার ফোন ও এসএমএস দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক শিক্ষার গবেষণার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটির প্রধান ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশে গবেষণায় মনোযোগ বৃদ্ধি ও অর্থ ব্যয় করতে সব মহল তাগিদ দেয়। এখন দেখা যাচ্ছে গবেষণা উপযুক্তভাবে না করে প্রকল্পে টাকা আছে, খরচ করতে হবে, টাকা ভাগাভাগি করতে হবে! বিষয়গুলো যেন এমন না হয়। হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্বনামধন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইইআর থেকে মানহীন গবেষণা আশা করা যায় না। গবেষণা কখনোই ইনকামের উৎস হতে পারে না।