
.
কোরবানির পশুবাহী ট্রাকে ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি রোধে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে হাইওয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশ ও ঢাকা রেঞ্জ পুলিশসহ জেলা পুলিশ। গতানুগতিক নিরাপত্তাব্যবস্থার বাইরে এসে এবার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছে পুলিশ। দেশের বড় বড় হাটকেন্দ্রিক জেলাগুলোর ফড়িয়াদের ডেটাবেজ করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও জেলাগুলোর হাট থেকে ট্রাকে গরু লোড করার পর একসঙ্গে ট্রাক নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ছাড়া হবে। এতে মহাসড়কে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা চাঁদাবাজি রোধ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া পশুবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি রোধে প্রতি ৮-১০টি ট্রাকের বহরে একজন করে পুলিশ সদস্য দেওয়া হবে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্প। নৌ পথে টহল বৃদ্ধি ও নৌ যানের সংখ্যা বাড়িয়েছে নৌ পুলিশ। এ ছাড়া ১ জুন থেকে সশরীরে মাঠে থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি ও নির্বিঘেœ যাতায়াতে কাজ করবে ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। ফলে বিগত বছরের তুলনায় এবার মহাসড়কে মানুষের নির্বিঘœ চলাফেরা, পশুবাহী ট্রাক কেন্দ্রিক অপরাধ রোধ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অধিক কার্যকর হবে বলে সকলে আশাবাদী।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রতিবছরই পথে পথে পশুবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। হাটে জোর করে পশুবাহী ট্রাক প্রবেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটে সহিংসতা। এবার এসব প্রতিহত করতে ও মহাসড়কে মানুষের চলাফেরা নির্বিঘœ করতে হাইওয়ে, নৌ ও ঢাকা রেঞ্জ পুলিশ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত জনবল মোতায়েন করা হয়েছে এসব দেখভালের জন্য।
দেশের যেসব জেলা থেকে ঢাকায় পশু ঢাকায় আনা হয় সেসব বড় বড় হাটকেন্দ্রিক জেলাগুলোর ফড়িয়াদের সঙ্গে বৈঠক করেছে হাইওয়ে পুলিশ। স্থানীয় প্রশাসন ও হাট ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও বৈঠক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ গত ১০ মে তথ্যসমৃদ্ধ ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ইন্টারেকটিভ ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেছে। এই ইন্টারেকটিভ ওয়েবসাইট প্রযুক্তিনির্ভর ও তথ্যবহুল একটি প্ল্যাটফর্ম। মহাসড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য এটি অত্যন্ত সহায়ক হবে বলেও ধারণা পুলিশের। এই ওয়েবসাইটে হাইওয়ে থানাসহ সংশ্লিষ্ট থানা, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, রেস্টুরেন্ট, পেট্রোলপাম্প, ওয়ার্কশপ এবং গরুর হাটের জিও লোকেশন, যোগাযোগ নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য থাকবে। ব্যবহারকারীর বর্তমান অবস্থান থেকে দূরত্ব ও রুট নির্দেশনাও থাকবে ওয়েবসাইটটিতে। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অস্থায়ীভাবে সাব-কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হচ্ছে। যাতে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটের তথ্যগুলো সহজেই পাওয়া যায়। কুইক রেসপন্স টিম থাকবে। মহাসড়কে বেশি যানজটের সৃষ্টি হলে সহজেই পৌঁছাতে মোটরসাইকেলে টহল দেবে এই টিমের সদস্যরা। রাতে চলাচলরত বাসে যাত্রীদের ভিডিও চিত্র ধারণ করা। মহাসড়কসংলগ্ন যেসব স্থানে পশুর হাট বসবে, সেসব স্থানে অতিরিক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা। মহাসড়কে অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য হাইওয়ে পুলিশের ইন্টেলিজেন্সের একাধিক টিম মহাসড়কে কাজ করবে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে মহাসড়কে যাতে কোনো প্রকার চাঁদাবাজি না হয়, সেজন্য হাইওয়ে পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধি করা। মহাসড়কে অবৈধ থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। ঈদের আগে তিন দিন মহাসড়কে ট্রাক, লরি ও মালবাহী ভারি যানবাহন চলাচল বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ঈদের আগে ও পরের সাত দিন মহাসড়কে সুনির্দিষ্ট পূর্ব তথ্য ছাড়া এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যানবাহন না থামানো ও চেকিং না করা।
এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয়ে কমিউনিটি পুলিশিং স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত করা হবে। সরকারি রেকার ছাড়াও সমন্বয়ের মাধ্যমে বেসরকারি রেকার ও ক্রেনগুলো প্রস্তুত রাখা হবে। প্রস্তুত রাখা হবে অ্যাম্বুলেন্স। বাসস্ট্যান্ড ও বাজারে যেখানে লোকসমাগম বেশি থাকে, সেখানে স্পেশাল টিম মোতায়েন করা হবে। জেলা, মেট্রোপলিটন, নৌ, শিল্পপুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। শুধু তাই নয়; এবার প্রযুক্তির সহায়তাও নিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। সংস্থাটির তথ্যমতে, পশুবাহী ট্রাকে থাকছে জিপিএস ট্র্যাকার ও ড্যাশ ক্যামেরা। এসব ট্র্যাকার ও ড্যাশ ক্যামেরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবে কেন্দ্রীয় হাইওয়ে পুলিশ। যেকোনো হাটে জোর করে পশুবাহী ট্রাক না ঢোকানো ও সম্ভাব্য ডাকাতির পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে সতর্ক অবস্থানেও থাকছে হাইওয়ে পুলিশ।
হাইওয়ে পুলিশপ্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেন, পশুবাহী ট্রাকে ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে হাটের জন্য পশুবোঝাই ট্রাক যাবে, শুধু সেই হাটেই থামবে। এ ক্ষেত্রে ট্রাকের সামনে ব্যানারে হাটের নাম লিখে রাখতে হবে। আর ট্রাকের নিরাপত্তা দিতে মহাসড়কের পথে পথে বিভিন্ন পয়েন্টে খোলা হচ্ছে কন্ট্রোল রুম। কোনো সমস্যা হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে। এসব কার্যকর করতে হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গতানুগতিক নিরাপত্তাব্যবস্থার বাইরে এসে এবার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে প্রযুক্তির সংমিশ্রণে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
শুধু স্থল পথেই নয়; নৌ পথেও বিভিন্ন জেলা থেকে কোরবানির পশু আনা হয় রাজধানীতে। ফলে নৌ পথেও পশু বোঝাই নৌকা ঘিরে চাঁদাবাজি, পশু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বিগত সময়ে। তাই এবারও পশুবাহী নৌ যান ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে নৌ পুলিশ। নৌপথের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পশুর হাটের ইজারাদার এবং নৌ পুলিশের সকল অঞ্চলের পুলিশ সুপারসহ নৌ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নৌ পুলিশের সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নৌপথে কোরবানির পশু পরিবহন নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে গত সোমবার বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে নৌ পুলিশ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অতিরিক্ত পশু বোঝাই নৌযান চলাচল করা থেকে বিরত রাখা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে নৌযান চালানো, চাঁদাবাজি, চুরিসহ যেকোনো হয়রানি বন্ধে বিশেষ নজরদারি বৃদ্ধি করা, নগদ অর্থ বহনের পরিবর্তে ব্যাংকিং মাধ্যমে লেনদেন, কোরবানির পশুর হাটে হাসিল আদায়ে ইজারাদার কতৃর্ক নিধার্রিত ফি প্রদর্শন করা, পকেটমার-ছিনতাইকারী-মলম/অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য রোধে সতর্ক ও সচেতন থাকা, পশু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পশুবাহী নৌযানে হাটের নামসহ ব্যানার প্রদর্শন করা।
জানতে চাইলে নৌ পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ান জনকণ্ঠকে বলেন, নৌপথে কোরবানির পশু পরিবহন নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে কেন্দ্রীয়ভাবে আমাদের বৈঠক হয়েছে। নৌ পুলিশের সব অঞ্চলেও একাধিক বৈঠক হয়েছে। তারা নৌ যান ব্যবসায়ী, গরু ব্যবসায়ী, ইজারাদারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আবার বৈঠক করেছেন। নৌ পথে ২৪ ঘণ্টা টহল দেওয়া হবে জানিয়েছে তিনি বলেন, নৌ যান বৃদ্ধিসহ নৌ পথে সব সময় টহল দেওয়া হবে। যাতে করে নৌ পথে আসা পশুর যান ঘিরে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে না পারে। ঈদের আগে ও পর পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলমান থাকবে। নদী তীরবর্তী হাটগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আলাদা আলাদা করে না ছেড়ে একসঙ্গে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে পশু বোঝাই যান ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রাতে বিচ্ছিন্নভাবে নৌযান না ছাড়াই ভালো। তবু কেউ রাতে পশু পরিবহন করতে চাইলে আমাদের সহযোগিতা নিতে পারবে। নৌ পথে পশু পরিবহনের জন্য তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে বেশি সংখ্যক নৌ পুলিশ প্রস্তুত রেখেছেন বলেও জানান তিনি।
তবে দেশের যেখান থেকেই পশুবাহী ট্রাক বা যান আসুক তা রাজধানীতে প্রবেশ করতে ঢাকা রেঞ্জ এলাকা হয়ে আসতে হয়। এক্ষেত্রে বৃহৎ ঢাকা রেঞ্জ এলাকায় বিগত সময়ে পশুবাহী ট্রাক ছিনতাই, জোর করে পশু অন্য হাটে নিয়ে যাওয়ার মতো অহরহ ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে সাভার, আমিন বাজার, কেরাণীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এলাকা হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ কালে প্রভাবশালী ইজারাদাররা জোর করে পশু তাদের হাটে নিয়ে যান। এবার এমন ঘটনা প্রতিহত করতে এবং চাঁদাবাজি রোধে মাঠে থাকবে ঢাকা রেঞ্জ পুলিরে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হাতেম আলী জনকণ্ঠকে বলেন, পশুবাহী ট্রাক ঘিরে চাঁদাবাজি বন্ধ ও ছিনতাই-ডাকাতি রোধে এবং সাধারণ মানুষের নির্বিঘেœ চলাফেরা নিশ্চিত করতে ১ জুন থেকে ঢাকা রেঞ্জের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠে থাকবে। প্রত্যেক রুটে সশরীরে সিনিয়র অফিসাররা এসব মনিটরিং করবেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া পশুবাহী ট্রাক থামাতে পারবেন না মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। বড় ধরনের কোন তথ্য থাকলে সিনিয়র অফিসারের উপস্থিতি পশুবাহী ট্রাক থামাতে পারবে। এ ছাড়া পশু ঘিরে ছিনতাই-চাঁদাবাজি রোধে চিহ্নিত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। এসেবর ফলে এবার পশুবাহী ট্রাক ঘিরে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
প্যানেল