
.
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস আজ শনিবার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিএইচও) সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস চালু করে। প্রতিবছর ৩১ মে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের অনান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের আওতাধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি) প্রতিবছরের মতো এবারও যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি উদ্যাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়া দিবসটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ধূমপনবিরোধী বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।
দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৫’ পালনের উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। সব ধরনের তামাকজাত পণ্য স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তামাক সেবনের ফলে হৃদরোগ, ক্যান্সার, স্ট্রোক, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, অ্যাজমা, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল ও প্রাণঘাতী রোগে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তামাক কোম্পানিগুলো তরুণ প্রজন্মকে তামাক সেবনে প্রলুব্ধ করতে নিত্যনতুন তামাকপণ্য আকর্ষণীয় প্যাকেজিং ও ডিজাইনে বাজারজাত করছে। আমাদের যুব সমাজকে তামাকজাত পণ্য থেকে দূরে রাখতে তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য-‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি’-একটি সময়োপযোগী আহ্বান। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ই-সিগারেট ও সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে এবং প্রচলিত তামাকপণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া, বিশ্ব স্থাস্থ্য সংস্থার ঋৎধসবড়িৎশ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঞড়নধপপড় ঈড়হঃৎড়ষ (ঋঈঞঈ)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ সংশোধন ও শক্তিশালী করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নে চিকিৎসক, পেশাজীবী, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, বেসরকারি সংস্থাসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। আমি বিশ্বাস করি, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামী প্রজন্ম তামাক ও নিকোটিনের সর্বনাশা ছোবল থেকে মুক্তি পাবে। আমি ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৫’ উপলক্ষে গৃহীত সকল কর্মসূচির সফলতা কামনা করি।” উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় তামাক। তামাক বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। তামাক খাত থেকে সরকার যে রাজস্ব পেয়ে থাকে, তার চেয়ে বরং কয়েকগুণ বেশি করতে হয় স্বাস্থ্য খাতে। কারণ, ধূমপানজনিত কারণে প্রতিবছর দেশে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে ধূমপানজনিত রোগে মৃত্যুহারও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ অবস্থায় ধূমপানের প্রধান কাঁচামাল তামাকপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ওপর কঠোর নির্দেশনা চায় সামাজিক সংগঠনগুলো। এদিকে, বিশ্বজুড়ে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সব প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার জন্য দিবসটি পালন করা হয়। এছাড়া দিবসটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তামাক ব্যবহারে ব্যাপকভাবে নিরুৎসাহিতকরণ এবং স্বাস্থ্যের ওপর তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানো। শুধু তাই নয়, তামাক চাষ, তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার এবং তামাকের বর্জ্য পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর, সে বিষয়ে জনসাধারণ এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয় দিবসটি পালনের মাধ্যমে।
জানা গেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বের ৯০ ভাগ তামাক উৎপাদন হয়। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সমাজের ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব ব্যাপক। বিশ্বের মোট তামাকের ১ দশমিক ৩ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। আমাদের দেশে আবাদযোগ্য জমিতে তামাক চাষের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। কারণ, যে জমিতে তামাক উৎপাদন করা হয়, সেখানে অন্য কোনো ফসল আর উৎপাদন করা যায় না। তামাকবিরোধী গবেষণা ও অ্যাডভোকোসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) তথ্য মতে, তামাক বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। বিপুল মৃত্যু এবং ব্যাধির উৎসমূল হওয়া সত্ত্বেও নানা ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। তামাকই পৃৃথিবীর একমাত্র বৈধ পণ্য, যা অবধারিতভাবে তার ভোক্তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। নতুন প্রজন্মই তামাক কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য। মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে যে শিশু বা কিশোর-কিশোরী আজ ঠোঁটে তামাকপণ্য তুলে নিচ্ছে, কাল সেই পরিণত হচ্ছে তামাক কোম্পানির আমৃত্যু ভোক্তায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে ১৩-১৫ বছর বয়সী অন্তত ৩ কোটি ৭০ লাখ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত তামাক ব্যবহার করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের (সিডিসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ বছর বয়সের আগেই যারা তামাকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন, তাদের মধ্যে নিকোটিন নির্ভরতা এবং আমৃত্যু তামাক ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩ বাস্তবায়নে প্রকৃত কোনো অগ্রগতির মুখ দেখেনি দেশ। সাম্প্র্রতিক সময়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের চলমান সংশোধনী প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত করতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে হস্তক্ষেপ জোরদার করেছে তামাক কোম্পানিগুলো। প্রজ্ঞার মতে, তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে যথাসম্ভব দ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্ত, ই-সিগারেটসহ সকল ভ্যাপিংপণ্য নিষিদ্ধ এবং তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ করা। সিগারেটের সহজলভ্যতা কমাতে নিম্নস্তর এবং মধ্যম স্তরকে একত্রিত করে মূল্যস্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে ৩টিতে নামিয়ে আনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি আর্টিকেল ৫.৩-এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করার কথা জানায় সংগঠনটি। টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বননিধনের জন্য তামাক দায়ী। এছাড়া তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশে ক্ষতিগ্রস্ত করছে দেশের পানি সম্পদ ও মৎস্য উৎপাদন। এ কারণে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী ইতোমধ্যে হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের ৪ কোটিরও অধিক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অফিস, বাড়ি কিংবা খোলা জায়গায় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার, যা স্বাস্থ্য খাতে রোগীর বাড়তি চাপের সৃৃষ্টি করছে। এ প্রসঙ্গে প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, তামাকের কারণে আমাদের আবাদযোগ্য জমি, বনভূমি, মৎস্যক্ষেত্র প্রভৃতি সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ, জলবায়ু এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে এই তামাক। সরকারের উচিত হবে শক্তিশালী আইন ও কর পদক্ষেপের মাধ্যমে তামাকের আগ্রাসন বন্ধ করা।
প্যানেল