
ছবি: সংগৃহীত
আল-কোরআনের সূরা মুলকের তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, পরম করুণাময় আল্লাহ সাত আসমান স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টিতে কোনো অসামঞ্জস্য নেই। আল্লাহ বলেন, “আবার দৃষ্টি ফিরাও, কোনো ত্রুটি দেখতে পাও কি?” ১৪০০ বছর আগে অবতীর্ণ এই মহাগ্রন্থে বহু স্থানে স্তরে স্তরে সাত আসমান সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই সাত আসমান বলতে কী বোঝানো হয়েছে? কী তাদের নাম, কেমন তাদের গঠন, কোথায় ও কিভাবে আছে এসব আসমান? আর এর সীমানা কতটুকু?
আমরা যেভাবে আকাশের অসীম বিস্তৃতি দেখতে পাই বা শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা যতদূর পর্যন্ত মহাশূন্যে দৃষ্টি প্রসারিত করতে সক্ষম, সেটিই কি সাত আসমানের সীমা? নাকি এর বাইরেও দৃষ্টিসীমার অতীত ছয়টি আসমান বিস্তৃত হয়ে আছে? বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান কি এই সাত আসমানের কোনো ব্যাখ্যা বা প্রমাণ খুঁজে পেয়েছে?
কোরআনের শব্দ 'সামাওয়াত' ও এর তাৎপর্য
আরবিতে 'আকাশ' শব্দের একবচন হলো ‘সামা’, আর বহুবচন ‘সামাওয়াত’, যার অর্থ 'আকাশসমূহ'। কোরআনে সাত আসমানের যেসব স্থানিক উল্লেখ আছে, সেখানেই ‘সামাওয়াত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে বোঝা যায় যে এখানে একাধিক স্তরবিশিষ্ট আকাশের কথা বলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সূরা নূহের ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমরা কি লক্ষ্য করো না, আল্লাহ কিভাবে স্তরে স্তরে সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন?”
মুসলমানরা একে আল্লাহর কালাম হিসেবে মেনে নিলেও বাস্তবে এই সাত আসমানের অস্তিত্ব নিয়ে অবিশ্বাসীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের অন্ত নেই। তাদের যুক্তি—বিজ্ঞান এখনো এর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলেন, কোরআনের 'সাত আসমান' বলতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের স্তরগুলো বোঝানো হয়েছে। কিন্তু কোরআনে কিছু স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে যা বাস্তবিকভাবেই সাত আসমানের অস্তিত্বের ধারণা দেয়।
সূরা ফুসসিলাত ও ‘সামা আদ্-দুনিয়া’ অর্থাৎ নিকটবর্তী আকাশ
সূরা ফুসসিলাতের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তিনি দুই দিনে আকাশমণ্ডলীকে সাত আসমানে বিন্যস্ত করলেন এবং প্রত্যেক আসমানের কার্যাবলি ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন। আমরা নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালায় সুসজ্জিত করেছি এবং সুরক্ষিত করেছি।” এখানে উল্লেখিত ‘সামা আদ্-দুনিয়া’ শব্দটি অর্থ করে ব্যাখ্যাকারীরা বলেছেন, এটি পৃথিবীর কাছাকাছি আকাশ। অর্থাৎ আমরা যে মহাকাশ দেখি—যেখানে গ্রহ-উপগ্রহ, তারকা ও গ্যালাক্সিগুলো ছড়িয়ে আছে—তা আসলে কোরআনের বর্ণিত প্রথম বা সর্বনিম্ন স্তরের আকাশ।
অতএব, এটি কোনোভাবেই বায়ুমণ্ডল নয় বরং এটি মহাশূন্য, এবং এর ঊর্ধ্বে রয়েছে আরও ছয়টি আসমান।
হাদিসের আলোকে আসমানের দূরত্ব
মুস্তাদরাকের একটি হাদিস অনুযায়ী, পৃথিবী থেকে প্রথম আসমানের দূরত্ব ৫০০ বছরের পথ। প্রত্যেক আসমান একে অপর থেকে একই দূরত্বে অবস্থিত। তবে এই ‘৫০০ বছর’ কিসে মাপা হবে, তা হাদিসে নির্দিষ্ট করা হয়নি। এটি আলোকবর্ষে, গতিতে না স্থানে—তা-ও বলা হয়নি। হয়তো এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার মতো মানবজাতির সক্ষমতা এখনো নেই, তাই আল্লাহ বিস্তারিত কিছু জানাননি।
নাস্তিকদের দাবি—মহাবিশ্বে যদি ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি ও বিলিয়ন তারকা থাকে, তাহলে কিভাবে মাত্র সাতটি স্তর হতে পারে? এ বক্তব্যে এমনভাবে ধরা হয় যেন মহাবিশ্বের সব রহস্য তারা বুঝে ফেলেছে। বাস্তবে, মানুষ এখন পর্যন্ত যে অংশে মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানে, তা সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রতম অংশমাত্র। আর কোরআনের তথ্য অনুযায়ীও মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। যার পরিসীমা সম্পর্কে কারোরই কোনো নির্ভরযোগ্য ধারণা নেই।
বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা ও ড. হালুক নূরের পর্যবেক্ষণ
এই প্রেক্ষিতে একটি উপমা দেওয়া যেতে পারে: ধরা যাক একটি আলমারিতে সাতটি ড্রয়ার আছে এবং প্রতিটিতে ২০টি কলম রাখা আছে। আপনি যদি বলেন এখানে ১৪০টি কলম আছে, তাই সাতটি ড্রয়ার থাকতে পারে না—এটা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি মহাকাশে অগণিত তারকা ও গ্যালাক্সি থাকলেও তা সাত স্তরের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
তুর্কি মহাকাশবিজ্ঞানী ড. হালুক নূর আধুনিক পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মহাকাশকে সাতটি স্তরে ভাগ করেছেন:
- সৌরজগত
- মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চুম্বকীয় বলয়
- স্থানীয় গ্যালাক্সি গুচ্ছ বা লোকাল গ্রুপ
- মহাজাগতিক কেন্দ্রীয় বলয়
- অতিদূরের গামা-রশ্মি বা আলোক তরঙ্গ উৎস
- মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীল ক্ষেত্র
- মহাবিশ্বের সীমাহীন অসীমতা
তবে এটি কোরআনের সাত আসমানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা নয়। এটি একধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা মাত্র, যা এখনো প্রমাণিত নয়। এটি মুসলিম বিজ্ঞানীর একটি প্রয়াস মাত্র।
ইমাম গাজালীর ব্যাখ্যায় সাত আসমানের নাম ও গঠন
ইমাম গাজালী (রহ.) তাঁর ‘মুকাশাফাতুল কুলুব’ গ্রন্থে সাত আসমানের নাম ও গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন:
- রোকিয়া – দুধের চেয়েও বেশি সাদা
- ফাইদুম/মাউন – লৌহ নির্মিত, যা আলো বিচ্ছুরণ করে
- মালাকুত/হারিয়ুন – তামার দ্বারা নির্মিত
- জাহিরা – সাদা রৌপ্য নির্মিত, চোখে আধার সৃষ্টি করে
- মুজাইনা/মুসাহারা – লোহিত স্বর্ণ নির্মিত
- খালিসা – আলোকিত মুক্তা নির্মিত
- লাবিয়া/দামিয়া – লাল ইয়াকুত দ্বারা নির্মিত, এখানেই বায়তুল মামুর অবস্থিত
কোরআনের তথ্য ও বিজ্ঞানের সত্যতা
বিজ্ঞান আজো আকাশের স্তর সম্পর্কে চূড়ান্ত কিছু জানাতে পারেনি। কিন্তু কোরআনের বহু তথ্য বহু বছর পরে বিজ্ঞান প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন—ভ্রূণ গঠনের ধাপ (সূরা মুমিনুন: ১৪), মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ (সূরা জারিয়াত: ৪৭), এবং পাহাড়ের স্থায়িত্বদান (সূরা নাবা: ৬)।
নাসার বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেছেন, ‘অবজারভেবল ইউনিভার্স’-এর বাইরেও রয়েছে অজানা এক রহস্যময় মহাবিশ্ব। তাহলে কিভাবে নিশ্চিত করে বলা যায় সাত আসমান নেই?
আল্লাহ বলেন, “আবার তোমরা বারবার আকাশের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখো—তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে।” (সূরা মুলক)
এসএফ