
নতুনভাবে ঢেলে সাজানো ঢাকার এই জাতীয় স্টেডিয়ামেই আগামী ১০ জুন সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলবেন হামজা চৌধুরী-সামিত সোমরা
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। বাংলাদেশের খেলাপাগল মানুষও এ খেলাটাকে ভীষণ ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। আশি-নব্বইয়ের দশকে ঢাকা ও মিরপুর স্টেডিয়ামে দর্শক ঢলের কথা এখনো রোমান্থন করেন অনেকে। কালের বিবর্তনে নানা অব্যবস্থাপনা আর খেলার পড়তি মানের কারণে ফুটবল থেকে অনেক মুখ ফিরিয়েছে নিয়েছেন! কিন্তু তারা মনেপ্রাণে চান, দেশে আমজনতার এ খেলার ধার আবার বাড়–ক।
দেশের নারী ফুটবলাররা চোখ ধাঁধানো ধারাবাহিক সাফল্য পেলেও পুরুষ দলের অবস্থা রুগ্ন। জামাল-তপুদের অবস্থা অনেকটা তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠা-নামার মতো। দুই ধাপ এগিয়ে গেলে পরক্ষণেই পাঁচ ধাপ পিছিয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় দেশের ফুটবলের মান উন্নয়নে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) বিদেশী বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। এ তালিকায় সংযোজন হয়েছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তারকা হামজা দেওয়ান চৌধুরী। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ২৭ বছর বয়সী হামজার লাল-সবুজের জার্স গায়ে খেলা নিশ্চিত হয়। এরপর গত মার্চে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে অভিষেক ম্যাচও খেলেছেন। ওই ম্যাচে হামজার দুর্দান্ত পারফরমেন্সে বিমোহিত হয়েছেন ফুটবলপ্রেমীরা।
লাল-সবুজের জার্সিতে অভিষেক হলেও সেটা হয়েছে বিদেশের মাটিতে। এখনো নিজ দেশের মাটিতে খেলা হয়নি হামজার। সেই অপেক্ষা ফুরোতে চলেছে আগামী ১০ জুন। ওইদিন নতুনরূপে সাজানো ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচে সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে খেলবেন হামজা। ম্যাচটি দিয়েই দেশের মাটিতে তার অভিষেক হয়ে যাবে। ম্যাচটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা। ইতোমধ্যে টিকিটের জন্য হাহাকার পড়ে গেছে। সবার মধ্যে একটিই বাসনা, যে কোনো মূল্যে হামজা-সামিত সোমদের খেলা সরাসরি মাঠে বসে দেখতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ দর্শককেই হতাশ হতে হচ্ছে। কেননা চাহিদার তুলনায় গ্যালারিতে দর্শক ধারণক্ষমতা অনেক কম।
অনেকদিন পর জাতীয় স্টেডিয়ামে খেলা ফিরছে। যে কারণে স্টেডিয়ামটির সংস্কারকাজের অগ্রগতি কেমন তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। এখানেই যে প্রথমবার ঘরের মাঠে খেলতে নামবেন হামজা চৌধুরী ও সমিত সোমরা। এর আগে ৪ জুন ভুটানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলার কথা আছে। দুটি ম্যাচই হবে জাতীয় স্টেডিয়ামে। প্রায় ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে চার বছর ধরে চলছে স্টেডিয়ামটির সংস্কারকাজ। সবশেষ এখানে ফুটবল মাঠে গড়িয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বরে। ভুটানের ম্যাচ দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে ৫৫ মাসের বিরতি। স্টেডিয়ামের ভেতরটা বেশ ফিটফাট করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাইরে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। স্টেডিয়াম চত্বরে দোকানপাট, যানজট, গাড়ি পার্কিং, ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ, হকারদের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ার মতো।
অনেকে তো মাঠের ভেতরে প্রবেশের গেইটই খুঁজে পান না! বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, এখানে কয়েকদিন পর আন্তর্জাতিক মানের একটি অত্যাধুনিক ফুটবল স্টেডিয়ামের নতুন যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। তবে স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করলে চোখের সামনে সুসজ্জিত, নতুন গোছানো সুন্দর একটি মনোরম চিত্রই ভেসে উঠবে। দ্বিতীয় কিংবা তিনতলায় গেলে পুরো স্টেডিয়ামের চিত্রটা এক নজরে দেখতে পাবেন। চোখে পড়বে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে রঙিন চেয়ার বসানো হয়েছে। ভিআইপি, ভিভিআইপি গ্যালারিতেও নতুন চেয়ার এসেছে। বড় স্ক্রিনও স্থাপন করা হয়েছে। ফ্লাডলাইট লাগানো হয়েছে। প্রেসবক্স, ড্রেসিংরুমগুলো নতুনভাবে সেজেছে। মাঠে সবুজ ঘাসের পরিচর্যা চলছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘ প্রায় চার বছরের সংস্কারের ফলে নবরূপেই সেজেছে জাতীয় স্টেডিয়াম।
স্টেডিয়ামটির সংস্কার কাজে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের আগস্টে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছিল। এই স্টেডিয়ামের মূল কাঠামো ঠিক রেখে সংস্কার কাজের নতুন নকশা তৈরি করে দেন দেশের খ্যাতিমান স্থপতি মাসুদুর রহমান। মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় স্থাপনার ডিজাইন তার হাতে করা। স্টেডিয়ামের প্রাথমিক বাজেট ধরা হয়েছিল ৯৮ কোটি টাকা। সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই অঙ্ক অনেক মোটাতাজা হয়েছে।
সংস্কারের পর আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক ফুটবল ভেন্যু হচ্ছে জাতীয় স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটির বেশকিছু স্থাপনায় নতুনত্ব এসেছে। বিশেষ করে গ্যালারির শেড, মাঠ, ড্রেসিং রুম, ফ্লাডলাইট, গ্যালারির চেয়ার, সিসিটিভি ক্যামেরা, জেনারেটর, এলইডি জায়ান্ট স্ক্রিন, অ্যাথলেটিক ট্র্যাক, ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বোর্ড, প্রেস বক্স, টিকিট কাউন্টার, ডোপ টেস্ট রুম, মেডিকেল রুম, ভিআইপি বক্স, প্রেসিডেন্ট বক্স নতুন করে সাজানো হয়েছে। মাঠে পানি সরবরাহের সিস্টেমেও পরিবর্তন এসেছে। বাফুফের চাহিদা অনুযায়ী স্প্রিংলারের পরিবর্তে অত্যাধুনিক পপ-আপ সিস্টেম করা হয়েছে।
দেড় ফুটের মতো মাটি সরিয়ে ফেলে মাঠ নতুন করে তৈরি করা এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা উন্নয়ন করা হয়েছে। দেশী দূর্বাঘাস লাগানো হয়েছে খেলার মাঠে। খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুম নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। আগের দুটির বদলে এখন আন্তর্জাতিক ও লোকাল দুটি করে মোট চারটি ড্রেসিং রুম জাতীয় স্টেডিয়ামে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের জিম, মেডিকেল রুম, ডোপ টেস্ট রুম তৈরি করা হয়েছে। বর্ধিত ও সুসজ্জিত হয়েছে পাঁচতলার মিডিয়া সেন্টার। ভিআইপি বক্সে ২০ ফুট বাই ৮ ফিটের বুলেটপ্রুফ গ্লাস লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া পুরো স্টেডিয়ামের লাইটিং ব্যবস্থায় ঢেলে সাজানো হয়েছে। বড় অঙ্কের অর্থে স্পেনের মাদ্রিদ থেকে ফিলিপস ব্র্যান্ডের ফ্লাডলাইট আনা হয়েছে। জাতীয় স্টেডিয়ামে সন্ধ্যার পর এ ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখা গেছে।
হামজাদের ম্যাচ ঘিরে বাংলাদেশের ফুটবলে এখন সাজ সাজ রব। সবখানে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। হামজা-সামিতদের খেলা দেখতে হলে একজন দর্শককে কমপক্ষে ৪০০ টাকা খরচ করতে হবে। আর টিকিটের সর্বোচ্চ মূল্য ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচের টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। ৯টি ক্যাটাগরির ১৮ হাজার ৩০০ টিকিট বিক্রি করবে দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ঃরপশরভু.ষরাব- এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে।
তবে টিকিট নিয়ে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা চোখে পড়েছে। যা নিয়ে ক্রীড়ামোদিদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। হসপিটালিটি বক্স, কর্পোরেট বক্সের প্রতিটি টিকিটের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা করে। ভিআইপি রেড বক্সের টিকিট ৪ হাজার টাকা। ভিআইপি-২ (খেলোয়াড়দের বেঞ্চের পেছনে) ও ভিআইপি-৩ (রেড বক্সের নিচে), ক্লাব হাউজ-১-এর প্রতিটি টিকিটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে আড়াই হাজার করে। স্কাই ভিউ-এর প্রতিটি টিকিট পেতে সমর্থকদের গুনতে হবে তিন হাজার টাকা। এছাড়া ক্লাব হাউজ-২ এর টিকিটের দাম দুই হাজার টাকা করে।
সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে সাধারণ গ্যালারির টিকিটের। মূল্য ৪০০ টাকা করে। বর্তমানে সংস্কার চলা জাতীয় স্টেডিয়ামের দর্শক ধারণ ক্ষমতা ২২ হাজারের কিছু বেশি। ভারতের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র দিয়ে বাছাইয়ের তৃতীয় রাউন্ড শুরু করে বাংলাদেশ। নিজেদের প্রথম ম্যাচে হংকংয়ের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে সিঙ্গাপুরও। ‘সি’ গ্রুপে চার দলেরই এ মুহূর্তে পয়েন্ট সমান ১ করে। একসময় ৫০ টাকার টিকিটেও যে ফুটবল স্টেডিয়ামের গ্যালারি ভরতো না, মাইকিং করেও দর্শক টানতে হিমশিম খেতে হতো, সেই দেশের ফুটবলে এখন নতুন জোয়ার। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হামজা চৌধুরী, কানাডাপ্রবাসী সামিত সোমদের মতো প্রবাসী ফুটবলারদের আগমন বদলে দিয়েছে দেশের ফুটবলের চিত্র। তাদের ঘিরে এখন সমাজের সর্বস্তরে ফুটবল নিয়ে আলোচনা।
সিঙ্গাপুর ম্যাচ ঘিরে বিস্তর আয়োজনের পরিকল্পনা করছে বাফুফে। ম্যাচের এক ঘণ্টা আগে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের একটি কনসার্টের পরিকল্পনা আছে তাদের। লেজার শোসহ আরও কিছু জমকালো আয়োজনের পরিকল্পনা করছে বাফুফে, যেটি সমর্থকদের জন্য বাড়তি চমক হিসেবে থাকছে।
এএফসির অনুমতি পেলে ম্যাচের বিরতিতেও আয়োজন রাখতে চায় বাফুফে। তবে সেটি ৫ মিনিটের বেশি নয়। সবমিলিয়ে হামজাদের ম্যাচ ঘিরে পুরো বাংলাদেশে এখন উৎসবমুখর আবহ বিরাজ করছে।