ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

গ্রামের হাঁড়িতে বাঁধা স্বাদ: হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার দই ঐতিহ্য

বাঁধন মোল্ল্যা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জামালপুর

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২৮ মে ২০২৫

গ্রামের হাঁড়িতে বাঁধা স্বাদ: হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার দই ঐতিহ্য

ছবি- দৈনিক জনকণ্ঠ

বাংলার প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে নিজস্ব স্বাদ ও সংস্কৃতি। তার মাঝেও গ্রাম বাংলার দই এক ঐন্দ্রজালিক নাম, শুধু স্বাদের নয়, বরং ঐতিহ্য, ভালোবাসা আর আত্মপরিচয়ের এক নিদর্শন। অথচ সময়ের স্রোতে, আধুনিকতার আঘাতে, বাজার ব্যবস্থার রূপান্তরে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প।

এক সময় বকশীগঞ্জ উপজেলার ঘরে ঘরে মহিষের দুধে তৈরি হতো দই। অতিথি আপ্যায়ন হোক কিংবা বিয়ের আয়োজন, ঈদের খুশি কিংবা পূজার প্রসাদ, মাটির হাঁড়ির দই ছাড়া যেন কিছুই সম্পূর্ণ হতো না। সেই দইয়ের মোটা সর, ঘন জমাট ভাব আর খাঁটি দুধের ঘ্রাণে থাকত এক অনন্য তৃপ্তির স্বাদ।

আজও জামালপুর জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে এই দইয়ের কদর অটুট। বকশীগঞ্জ সদরের বাজার, নঈম মিয়ার হাট, খেয়ারচর, রামরামপুর সকালবাজার, দেওয়ানগঞ্জ সদর, সানন্দবাড়ী, ঝালোরচর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ীসহ বহু অঞ্চলে মহিষের দই এক নিজস্ব ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বগারচর ইউনিয়নের টালিয়াপাড়া ও আশপাশের এলাকায় কিছু পরিবার আজও একমাত্র দই বিক্রিই করে জীবনধারণ করছেন এবং হয়েছেন আত্মনির্ভর।

টালিয়াপাড়ার এক দই ব্যবসায়ী জানান, এই দইয়ের ব্যবসা আমার দাদা শুরু করেছিলেন। পরে আমার বাবা চালান, এখন আমি করছি। একসময় টিনের ঘরে থাকতাম। দই বিক্রি করেই আজ পাকা দালান বাড়ি করেছি। জমি কিনেছি এবং মহিষ কিনেছি, কঠোর পরিশ্রম করে আজ একটা পরিচয় গড়েছি। দই আমার জীবনের সাথেই জড়িয়ে আছে। তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠছিল আত্মমর্যাদার দীপ্তি।

তিনি আরও বলেন, আমি এখনও মাটির হাঁড়িতেই দই জমাই। পুরনো ক্রেতারা সেই হাঁড়ির দই-ই চায়। ওর মধ্যেই গ্রামের গন্ধ, মাটির স্বাদ।

তবে সময়ের আঘাতে এই ঐতিহ্যের ভাঙন এখন স্পষ্ট। মাটির হাঁড়ির জায়গা নিয়েছে প্লাস্টিক পাত্র, খাঁটি দুধের বদলে এসেছে গুঁড়ো দুধ। চকচকে প্যাকেটজাত দই হয়তো দেখতে আকর্ষণীয়, সংরক্ষণেও সুবিধাজনক, কিন্তু তাতে নেই সেই মাটির হাঁড়িতে জমা দইয়ের প্রাণ, সেই স্বাদ, সেই ঘ্রাণ।

এই দই শুধু একটি খাবার নয়, এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস। দই তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে বহু নারী-পুরুষ হয়েছেন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। বাড়িতে দই তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে অনেকেই চালাচ্ছেন সংসার, পড়াশোনা, চিকিৎসা। দই তৈরির কাজ যেমন শৈল্পিক, তেমনই এটি একটি ক্ষুদ্র হস্তশিল্প, যা টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খাঁটি দইয়ে রয়েছে ক্যালসিয়াম, প্রোবায়োটিক ও হজমে সহায়ক উপাদান যা পেটের নানা সমস্যা প্রতিরোধে কার্যকর। তাই দই কেবল রসনার নয়, স্বাস্থ্য সচেতনতাও বয়ে আনে।

গ্রাম বাংলার দই এক সাংস্কৃতিক পরিচয়। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সরকার ও সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ, প্রশিক্ষণ, অনুদান, বাজার সংযোগ এবং উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানো। না হলে একদিন হয়তো হারিয়ে যাবে হাঁড়ির দইয়ের সেই সর, সেই ঘ্রাণ, আর সেই মাটির আঁচে বাঁধা আত্মার স্বাদ।

নোভা

×