ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঢোপকল: রাজশাহীর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের জলজ স্মৃতি

তানভীরুল আলম তোহা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ২৭ মে ২০২৫

ঢোপকল: রাজশাহীর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের জলজ স্মৃতি

প্রতিটি শহরের থাকে নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য যা সেই শহরের মানুষের গর্বের জায়গা। রাজশাহীও তার ব্যতিক্রম নয়। নগরবাসীর স্মৃতিতে আজও জড়িয়ে আছে রাজশাহীর এক সময়কার গর্ব “ঢোপকল” একটি বিস্মৃতপ্রায় অথচ ঐতিহাসিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা।

১৯৩৭ সালে মহারানী হেমন্ত কুমারীর উদ্যোগে রাজশাহী শহরে স্থাপিত হয় এই ঢোপকল। মূল লক্ষ্য ছিল শহরবাসীর জন্য বিশুদ্ধ ও পানযোগ্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। সে সময় রাজশাহী শহরে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। কলেরা, আমাশয়সহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়।

তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান রাইটিন দাশগুপ্ত রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাজশাহীর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঢোপকল বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কলকাতা মিনিস্ট্রির অধীনে রাজশাহীতে স্থাপিত হয় পানি বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র। প্রায় আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় পুরো প্রজেক্ট, যার মধ্যে মহারানী হেমন্ত কুমারী নিজে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। তাঁর সম্মানেই পরবর্তীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার নাম হয় “হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস”, যা পরে পরিচিতি পায় “হেমন্ত কুমারী ঢোপকল” নামে।

প্রতিটি ঢোপকলেই ছিল ৪৭০ গ্যালন পানির ধারণক্ষমতা এবং একটি রাফিং ফিল্টার। প্রথমে পাথরকুচির ফিল্টার দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা হতো, পরে তা সিমেন্টের পাইপে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। ঢোপকলগুলো এতটাই মজবুত ছিল যে সহজে ভাঙার নয়। প্রতি দুই মাসে এসব ঢোপকল পরিস্কার করা হতো ব্লিচিং পাউডার দিয়ে।

তৎকালীন রাজশাহীর দাশপুকুর, শিরোইল, বেলদারপাড়া, ফায়ার ব্রিগেড সহ বিভিন্ন এলাকায় এসব ঢোপকলের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হতো। ঢোপকল শুধু পানি সরবরাহ ব্যবস্থাই ছিল না, এটি রাজশাহীর সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও জনসেবার একটি দৃষ্টান্ত ছিল।

এক সময় রাজশাহী শহরজুড়ে ছিল একশোরও বেশি ঢোপকল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনো দু-একটি ঢোপকল দেখা গেলেও সেগুলো কার্যত অচল।

বর্তমানে রাজশাহীর পানি সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছে ওয়াসা, যার পানি আসে আধুনিক পানি শোধনাগার থেকে। ঢোপকল ব্যবস্থার সেই ঐতিহাসিক সৌন্দর্য আর প্রযুক্তির ছোঁয়া আজ আর নেই।

বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা মনে করেন, ঢোপকল ছিল শুধুমাত্র পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নয় বরং একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। তাই রাজশাহীর কয়েকটি মোড়ে ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ঢোপকল সংরক্ষণ ও চালু রাখা যেতে পারে। এতে নতুন প্রজন্ম যেমন জানবে শহরের ইতিহাস, তেমনি নগর সৌন্দর্যে যুক্ত হবে অতীতের গৌরব।

ঢোপকল শুধু একটি পানির কল নয় এটি রাজশাহীর অতীত গৌরব, যা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা এখন সময়ের দাবি।

মিমিয়া

×