ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

পোশাকে পতাকার গল্প: তাসমিত আফিয়াত আর্নি

মাহবুব নাহিদ

প্রকাশিত: ১৭:৫৭, ১৬ জুন ২০২৫

পোশাকে পতাকার গল্প: তাসমিত আফিয়াত আর্নি

ছবি: সংগৃহীত

“জার্সিটি গায়ে চড়ালে মনে হয়, যেন আমি বাংলাদেশকে কাঁধে নিয়ে মাঠে নামছি।” — ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ফুটবলার হামজা চৌধুরীর এই এক লাইনে যেমন লুকিয়ে আছে জাতীয় গর্ব, তেমনি আছে এক নারীর সৃজনশীল শ্রমের প্রতিচ্ছবি। তিনি তাসমিত আফিয়াত আর্নি—একজন তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার, যিনি পোশাকে ফুটিয়ে তুলছেন দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়।

ঢাকায় বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের মেয়ে আর্নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন । ‘ঘ’ ও ‘চ’ উভয় ইউনিটে সুযোগ পেলেও বাবার ইচ্ছা ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ুক মেয়ে। কিন্তু নিজের ভালো লাগা বেছে নিলেন আর্নি—গ্রাফিক ডিজাইন। বাবার সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই চালান। করেছেন অনেক বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাজ ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে, কুড়িয়েছেন প্রশংসা, ইন্টার্নশিপ করেছেন ‘ইয়েলো’ ফ্যাশন হাউসে। ফ্যাশন ডিজাইনে কাজের হাতেখড়ি সেখানেই।

ফ্যাশন রিয়েলিটি শো ‘স্টাইলগুরু’তে ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডিজাইনার বিবি রাসেলের কাছে। চলচ্চিত্রেও রেখেছেন পদচিহ্ন—রুবাইয়াত হোসেনের Under Construction সিনেমায় সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি।
২০১৮ সালে ‘মিস ওয়ার্ল্ড’-এ বাংলাদেশের প্রতিনিধি জেসিয়া ইসলামের সব পোশাক ডিজাইন করেছিলেন আর্নি। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘মিস ইউনিভার্স’-এ অংশগ্রহণকারী শিরিন শিলা তাঁর ডিজাইন করা রিকশা হুড ও বর্ণমালা গয়নায় সেজে মঞ্চে ওঠেন। সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল—“বলতে হয়নি মেয়েটা কোন দেশের”।

ইন্দোনেশিয়ায় ‘মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল’-এ আলোচিত হয় তাঁর লাল জামদানির গাউনশাড়ি, তালপাতার মুকুট আর মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে অনুপ্রাণিত গয়না। এসব ডিজাইন শুধু পোশাক নয়—একটি জাতির পরিচয় তুলে ধরেছে বিশ্ববাসীর সামনে।
২০২৫ সালের এশিয়ান কাপ উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অ্যাওয়ে ও হোম জার্সি ডিজাইন করেছেন তাসমিত আফিয়াত আর্নি। অ্যাওয়ে জার্সির গায়ে আঁকা হয়েছে দেশের প্রধান নদীগুলোর জ্যামিতিক রূপ, কাঁধে শাপলার হীরা-ফর্ম, টাইপোগ্রাফিতে ‘BANGLADESH’ এবং পেছনে মানচিত্রের প্রতিফলন।

হোম জার্সি সবুজ রঙের, যেখানে জামদানি মোটিফে দোয়েল, ইলিশ, বাঘ আর সুন্দরবনের প্রতীক থাকছে। “লাল জার্সি পরা খেলোয়াড়রা সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলে তা যেন পতাকার মতোই লাগে”—আর্নির নিজের ভাষায়।

উল্লেখ্য, তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ‘Creative Director & Marketing Committee’ সদস্য হিসেবে কাজ করছেন।

২০১২ সালে নিজের ফ্যাশন হাউস Stride Fashion Wear প্রতিষ্ঠা করেন আর্নি। লক্ষ্য—স্থানীয় উপাদান দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব বিলাসবহুল ফ্যাশন। তাঁর ডিজাইনে থাকে জামদানি, গামছা, খাদি, নকশিকাঁথা, রিকশা পেইন্ট, মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ এমনকি বাংলা বর্ণমালা।

আর্নির মতে, “ফ্যাশন মানে শুধু বাহারি পোশাক নয়; এটি দেশের গল্প বলার মাধ্যম।” চীন, কাতার, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে তাঁর ব্র্যান্ডের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে।

২০২২ সালে একজন মার্কিন কূটনীতিক কে বিয়ে করেন আর্নি। বিয়ের গায়েহলুদ, বিয়ে ও সংবর্ধনার সব পোশাক নিজেই ডিজাইন করেছিলেন। রিকশা পেইন্ট, জামদানি ও লোকজ মোটিফে তৈরি সেই পোশাক নজর কেড়েছে অনেকের। এরপর অনেক বর-কনেরাই দেশীয় থিমে বিয়ের পোশাকের জন্য আর্নির দ্বারস্থ হন।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও হৃদয়ে বাংলাদেশ। জামদানি, নকশিকাঁথা ও বাংলার লোকজ ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বিশ্বমঞ্চে। তাঁর লক্ষ্য—বিশ্বকে জানানো, “আমার দেশকে জানো আমার পোশাকের মধ্য দিয়ে।”

তাসমিত আফিয়াত আর্নি একাধারে শিল্পী, সংগ্রামী ও সংস্কৃতির দূত। ডিজাইনের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করছেন—জাতির পরিচয় শুধু পতাকায় নয়, পোশাকেও গর্বের সঙ্গে ফুটে উঠতে পারে। তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি আঁচড়ে লুকিয়ে আছে বাংলার গল্প, ঐতিহ্য আর আত্মমর্যাদা।

ফারুক

×