ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতির জানালা দিয়ে দেখা

হারিয়ে যাওয়া এক কাঠের পুল

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ১৪:১১, ২৯ জুন ২০২২

হারিয়ে যাওয়া এক কাঠের পুল

গেন্ডারিয়ার কাঠের পুল, এখন শুধুই স্মৃতি

পদ্মার ওপর বিরাট এক সেতু হয়ে গেলএই সেতু নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনাএকই সময় আমরা আসুন একটু পেছন ফিরে তাকাইতাহলে দেখব একটি কাঠের পুল ঘিরে দারুণ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে খোদ ঢাকার মানুষজনসামান্য কাঠের পুলএর পরও কৌতূহলের সীমা নেইস্থানীয়রা পুল দিয়ে পার হওয়ার সময় দারুণ গর্ব অনুভব করছেনআশপাশের এলাকার মানুষেরাও আসছেন সেতুটি দেখতেআর এখন? সবই অতীতপুলের কোন অস্তিত্ব নেইপুল ঘিরে অযুত স্মৃতি বাসা বেঁধে আছে অপেক্ষাকৃত প্রবীণদের মনে

তবে কাঠের পুলের তথ্য সমৃদ্ধ সঠিক ইতিহাস সেভাবে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না

ঢাকা বিষয়ক গবেষক ও ঢাকা ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী হাশেম সূফীর মতে, কাঠেরপুল নির্মাণ করে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি১৮৬৪ সালের ১ আগস্ট ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি সৃষ্টি হয়১৮৮৫ সালে এর প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান হন আনন্দ চন্দ্র রায়ইতিহাসের আলোকে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সূফী বলেন, কাঠেরপুল নির্মিত হয় ১৮৮৫ সালের পর, ১৯০০ সালের মধ্যেপুলটি গে-ারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের সঙ্গে কুলুটোলার সংযোগ ঘটায়

আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, গে-ারিয়াতে এক সময় প্রচুর গে-ারি বা আখ হতোসেই আখের ওপর নির্ভর করে সূত্রাপুরে সুগার মিল গড়ে তোলা হয়েছিলডিস্টিলারি রোডে আবার ছিল ঢাকার প্রথম মদের কারখানাবাণিজ্যিক এসব কারণেও এ এলাকার যোগাযোগের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল, নির্মাণ করা হয়েছিল কাঠেরপুল

তথ্যমতে, ব্রিটিশ আমলে ঢাকার গে-ারিয়ায় নির্মিত হয়েছিল এই কাঠের পুলগে-ারিয়ার পশ্চিমে সংযোগ রক্ষার্থে এটি নির্মাণ করা হয়ধোলাইখালের কথা আমরা জানিএক সময় সত্যি এটি খাল ছিলএ খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল কাঠের পুলকাঠ দিয়ে গড়া, তাই কাঠের পুল নামে পরিচিতি পায়সে সময় শহরে আর কোন কাঠের পুল ছিল বলে জানা যায় নাগে-ারিয়ার মানুষ সেতুটি প্রতিদিন ব্যবহার করতেনবড়রা কাজে যেতেন সেতু পার হয়েব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা যাতায়াত করতেন সকাল-বিকালবিশেষ করে শিক্ষার্থীদের খুব কাজে লেগেছিল কাঠের পুলএকইভাবে নারিন্দা থেকে গে-ারিয়া যেতে ব্যবহৃত হতো পুলটি।    

গে-ারিয়ার কাঠের পুলের একটি ছবিই (এ লেখার সঙ্গেও ছাপা হয়েছে) ঘুরে ফিরে সামনে আসেরঙিন সে ছবিতে দেখা যায়, খালের ওপর নির্মিত পুলের পুরোটাই কাঠনিচ দিয়ে নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা রেখে নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়এর ফলে কাঠের পুলের মাঝখানটা ছিল যথেষ্ট স্ফীতদেখতে আজকের দিনের ফুটওভার ব্রিজের মতোপুলে ছিল কাঠের পাটাতনখুঁটিগুলোও ছিল কাঠেরদুপাশে আবার কাঠের উঁচু রেলিং ছিলফলে সেতু থেকে পরে যাওয়ার শঙ্কা ছিল নাঅবশ্য কাঠের সেতু মাঝে মধ্যে ভেঙ্গে যেত বলে জানা যায়তখন নৌকা করেই খাল পাড় হতে হতোআর কোন বিকল্প ছিল নাবহু বছর ব্যবহৃত হওয়ার এক পর্যায়ে ধোলাইখাল শুকিয়ে যায়নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ শুরু হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কাঠের পুল

তবে এই পুলটি ঘিরে প্রবীণদের আছে অসংখ্য স্মৃতিসেইসব স্মৃতির খোঁজ করতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সন্ধান মেলে মাহফুজা মঈনেরপ্রবাসী এই নারীর বয়স এখন অনেকতবুও শৈশবে কাঠের পুল ব্যবহার করার স্মৃতি তিনি ভুলে যাননিতার বর্ণনা মতে, একবার  মনিজা রহমান স্কুলের বেশ কিছু ছাত্রী পুলের ওপর দিয়ে বাড়ি ফিরছিলঠিক তখনই পুলটি ভেঙ্গে পড়েছাত্রীরাও নিচে পড়ে যায়দু-একজন খুঁটি ধরে আটকে ছিলবাকিরা সরাসরি নিচেভাগ্যিস তখন শুকনার মৌসুম ছিল, তাই রক্ষাএর পরও নিচে যারা পড়েছিল, তারা কাদা আর নোংরা পানিতে একেবারে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলপুলটি ভেঙ্গে গেলে বিকল্প হিসেবে মন্দিরের পাশ দিয়ে চিকন বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হতো বলেও জানান তিনিআর এ সাঁকো পার হতে গিয়ে বিপদ কয়েকগুণ বেড়ে যেততাই কাঠের পুলের জন্যই অপেক্ষা করতেন সবাই

এমন অম্লমধুর স্মৃতিকথা যেন আরও অনেকের স্মৃতিকে উস্কে দেয়প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা জিকরুর রেজা খানম বলছিলেন, এই পুল পার হয়ে ভার্সিটি যেতামএকবার পেন্সিল হিলের একটা আটকে গেল কাঠের পাটাতনের ফাঁকেবেরই হলো নাহিলটাই আলগা হয়ে নিচে পড়ে গেলআর কি! খালি পায়েই এসে রিক্সায় উঠলাম। 

জিয়া হাসান নামের আরেকজন জানাচ্ছেন, তিনি এই পুলের ওপর দিয়ে নিয়মিত কলেজিয়েট স্কুলে যেতেন

তবে মাহফুজা মঈনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্যসে তথ্য অনুযায়ী, কাঠের পুলের যে রঙিন ছবিটির কথা কিছুক্ষণ আগে বলা হচ্ছিল সেটি তাদের বাসায় অতিথি হয়ে আসা এক বিদেশী বন্ধু তুলেছিলেনমাহফুজা মঈন বলছেন, এই ছবিটি সম্ভবত ১৯৭৬ বা ৭৭ সালের হবেআমার স্বামীর একজন বন্ধু লন্ডন থেকে এলেনউঠলেন আমাদের গে-ারিয়ার বাসায়বিদেশী ভদ্রলোকের নিকট বাসা সংলগ্ন কাঠের পুল এক অত্যাশ্চর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ালতিনি তার নিজের সঙ্গে করে আনা ক্যামেরা দিয়ে পুলের ছবি তুললেনসদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তখনও রঙিন ছবি তেমন হয় নাউনি তুললেনরঙিন ছবির কয়েকটা প্রিন্ট আমাদের দিয়েছিলেনএই ছবিটি সেগুলোর একটি বলে জানান তিনি

কাঠের পুল সম্পর্কে জানতে কথা হয় গে-ারিয়ার সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক মানজার চৌধুরী সুইটের সঙ্গেওসে সময়ের বাস্তবতা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই গে-ারিয়াতেই তখন খাল ছিলখালে নৌকা চলতআমরা নৌকা চলতে দেখেছিনৌকায় চড়েছিধোলাইখালে নৌকাবাইচ হতোবিপুল আগ্রহ নিয়ে আমরা নৌকা বাইচ দেখেছিহারিয়ে যাওয়া সমাজ সংস্কৃতিরই অংশ ঐহিত্যবাহী কাঠের পুলপুলের জায়গায় এখন কংক্রিটের স্থাপনাআজকের প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না যে, আমরা নদীর এক কাছে ছিলাম! নগরায়নের পক্ষে মত দিলেও ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার জোর দাবি জানান তিনি

×