মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ বজলুর রহমান বাদল। সবাই তাকে চেনেন নৃত্যগুরু বজলুর রহমান বাদল হিসেবে। নাচের বাদল ভাই হিসেবেও রাজশাহীজুড়ে খ্যাতি তার। এ বছর তার বয়স ছুঁয়েছে ৯৪ বছরে। বয়সের ভারে কিছুটা নুব্জ্য হলেও মনের জোর এখনও প্রবল এ নৃত্যগুরুর। নৃত্যে শুধু স্থানীয় পর্যায়ে নয়, জাতীয় পর্যায়েও রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান। নৃত্যগুরু বাদল এবার রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’ পাচ্ছেন। ২০১৭ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য অন্যদের সঙ্গে তিনিও সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ মনোনীত হয়েছেন। আগামী ২৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করবেন। তার এ স্বাধীনতা পদক অর্জনে অনেকটাই আনন্দিত রাজশাহীবাসী। তিনি নিজেও আপ্লুত। জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তবে এবার স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তিতে তিনি অনেক খুশি। প্রতিক্রিয়ায় এ নৃত্যগুরু বলেন, দীর্ঘজীবনে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন রাজা-মহারাজার দরবারে নৃত্য পরিবেশন করে পেয়েছেন বিপুল সম্মান। এখনও মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসায় সিক্ত তিনি। শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন নৃত্যগুরু উপাধি। এ বছর তিনি সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন এটা তার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি বলে মনে করছেন গুণী এ নৃত্যশিল্পী। তিনি বলেন, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তি জীবনের স্বপ্ন ছিল। আমার সৌভাগ্য যে আমি এ পুরস্কার পাচ্ছি। তিনি বলেন, সেই ছোটবেলা থেকে সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। এ যাবত তিনি ৭৪ বার সংবর্ধনা পেয়েছেন। ঘরে তার সম্মাননা ক্রেস্ট রয়েছে ৬১। এগুলো সযতেœ আগলে রেখেছেন তিনি। ওস্তাদ বজলুর রহমান বাদল বলেন, সেই তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় ওস্তাদ তার হাতে-পায়ে নাচের যে মুদ্রা তুলে দিয়েছিলেন, তা এখনও সচল। এখনও নাচের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। শহরের সব বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এখনও তার সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি নাচ ছাড়া আর কিছুই করেননি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। থাকেন রাজশাহী নগরের শিরোইল এলাকায় মেয়ের বাসায়। ধ্রুপদি নৃত্যের চারটি বিভাগেই বজলুর রহমানের দক্ষতা সমান। এছাড়া ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরি ও কত্থক নৃত্যেও রয়েছে তার অসামান্য দখল। বজলুর রহমান ১৯২৩ সালের ১৮ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ব পুরুষেরা কলকাতার মানুষ ছিলেন। তার দাদা আশাক হোসেন আমের ব্যবসা করতে এসে মালদহে বাড়ি করেছিলেন। সেখানেই তার জন্ম। বাবার নাম আবুল কাশেম। মায়ের নাম সখিনা বিবি। ১৯৪৫ সালে মালদহ জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। পরের বছর নাটক করতে রাজশাহী আসেন। আর ফেরা হয়নি। এখনও রাজশাহীতেই আছেন। এখনও সপ্তাহে দু’দিন রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমিতে নাচের ক্লাস নেন। ওস্তাদ বজলুর রহমানের বসার ঘরে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন সংবর্ধনায় পাওয়া সম্মাননা ক্রেস্ট। ঢাকাসহ সারাদেশে তাকে ৭৪টি সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামানের দাদা সেই কবে তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, সেই ছবিও রয়েছে তার কাছে। আগে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন রাজা-মহারাজার দরবারে নাচের আমন্ত্রণ পেতেন। তিনি বলেন, ১৯৫১ সালে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার সঙ্গে নাচের মুদ্রা রপ্ত করে ফেলেন। তার বিদ্রোহী নৃত্যের জন্য ২০১১ সালে তিনি নজরুল একাডেমি পুরস্কার পান। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার পান। বজলুর রহমানের ভাষায়, মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর তাকে ‘ইয়াং বয়’ বলে সম্বোধন করেন। দেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী নিপা, শিবলী, লায়লা হাসান, জিনাত বরকতুল্লাহ সবার সঙ্গে রয়েছে তার সখ্য। নৃত্যশিল্পী রিংকু, ওলি ও সাকিবকে তিনি নিজ হাতে নৃত্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বলেও জানান প্রবীণ এ নৃত্যগুরু। এদিকে নৃত্যগুরুর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তিতে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ আতাউল গণি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তার স্বাধীনতা পুরস্কারে জেলা প্রশাসনও গৌরববোধ করছে। এদিকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য নৃত্যগুরু ওস্তাদ বজলুর রহমান বাদল নির্বাচিত হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, রাজশাহী এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা। এছাড়া রাজশাহীর বিভিন্ন মহলের ভালবাসা ও শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন তিনি।
শীর্ষ সংবাদ: