ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

বর্ষার রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাস, প্রকৃতির এক নীরব সৌন্দর্য

মোছাঃরোকেয়া সুলতানা, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী কলেজ

প্রকাশিত: ২১:১২, ৯ জুলাই ২০২৫

বর্ষার রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাস, প্রকৃতির এক নীরব সৌন্দর্য

রাজশাহী কলেজ শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি সময়ের দীর্ঘ স্রোতে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত ইতিহাস। প্রায় দেড় শতাব্দীর জ্ঞানচর্চার গৌরবময় স্মৃতি লুকিয়ে আছে এই প্রাঙ্গণের প্রতিটি ইট-পাথরে, করিডোরে, ক্লাসরুমে। কিন্তু বর্ষায় শ্রাবণের একরাশ মেঘ যখন এই আকাশে জমে ওঠে, তখন এই ইতিহাস যেন হঠাৎ করে ভিজে ওঠে আবেগে, স্মৃতিতে, সৌন্দর্যে।

আকাশে হঠাৎ মেঘ জমে। সূর্যের আলো মুছে গিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের নরম বিষণ্নতা। তারপর ধীরে ধীরে শুরু হয় বৃষ্টি মৃদু, কোমল, ঘন, কখনো বা অঝোর। চারদিকের সবুজ ঘাস, খয়েরী-ইটের ভবন, শতবর্ষী বৃক্ষ সবকিছু যেন এক অপার্থিব রূপে ধরা দেয়। এ যেন কেবল বৃষ্টি নয়, যেন রাজশাহী কলেজ নিজের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে-মুছে নিচ্ছে শ্রাবণের বিষণ্নতা।

পুরোনো ভবনগুলোর খয়েরি ইট ভিজে উঠে দাঁড়ায় নতুন রঙে। ছাদের কার্নিশ গড়িয়ে নামা জলের ধারা আর জানালার ফ্রেম থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়া জল সবকিছুতে যেন এক মায়াময়তা ছড়িয়ে পড়ে।

বর্ষার দিনে রাজশাহী কলেজের ফুলগুলোও হয়ে ওঠে আবেগের বাহক। কলেজ প্রাঙ্গণের বেলি ফুলগুলো ছড়িয়ে দেয় নিজের সুবাস,যা যে কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে।এছাড়া কোথাও নির্জনে ফুটে থাকা গন্ধরাজ, কোথাও লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখা জবা, কিংবা রঙ্গনের গুচ্ছ—সবকিছু বৃষ্টিতে আরও উজ্জ্বল, আরও জীবন্ত হয়ে উঠে। লাল,নীল,বেগুনি,পুরোনো,স্নিগ্ধ সাদা পাঁপড়িতে জমা জলবিন্দু মুক্তোর মতো ঝলমল করে, আর বাতাসে ভেসে আসে নরম মিষ্টি গন্ধ। এসব ফুল কেবল প্রকৃতির অলংকার নয়, তারা যেন কলেজের প্রতিটি শ্রাবণ স্মৃতিকে গেঁথে রাখে হৃদয়ের গহিনে।

ক্যাম্পাসের প্রাণ পদ্মপুকুর এই সময় পুরোনো ওঠে এক ধ্যানমগ্ন কবিতা। জলে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ যেন কোনো সুর, যা শোনা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। ভেসে থাকা পদ্মপাতা আর আধা-ফোটা ফুলের ওপরে যখন আকাশ ছায়া ফেলে, তখন পুকুরটি হয়ে ওঠে হৃদয়ের গভীর কোনো আয়না, যেখানে প্রতিফলিত হয় না শুধু প্রকৃতি, বরং মনের নির্জনতা।

কলেজ ক্যান্টিনের এক কাপ চা,হালকা বৃষ্টি,মৃদু বাতাস, মাথার ওপর পাতার ছায়া, আশেপাশে ফোঁটা পড়ার টুংটাং শব্দ—আর নিজের ভিতরে জমে থাকা কোনো অপূর্ণ অনুভব সব মিলিয়ে  শ্রাবণ যেন শুধু আকাশ থেকে নামে না, নামে মনের ভিতর থেকে।

বর্ষায় কলেজের পেছনের মাঠটা  যেমন প্রাণ ফিরে পাই, তেমনই শিক্ষার্থীদের বৃষ্টি বিলাসে হয়ে উঠে মুখরিত। এসময় শিক্ষার্থীরা বৃষ্টিতে ভিজে মেতে উঠে ফুটবল, ক্রিকেট থেকে শুরু করে নানা রকম খেলাধুলায়। বৃষ্টিতে ভিজে, কাঁদায় লুটোপুটো খেয়ে তারা যেন ফিরে যায় তাদের শৈশবে।

এর বাইরেও বৃষ্টিতে কেউ ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবে ফেলে আসা কাউকে, কেউ জানালার পাশে বসে নিজের না বলা কথাগুলোকে সাজায় কবিতার ছন্দে। বর্ষা তখনই হয়ে ওঠে আত্মার সঙ্গী, নিঃশব্দ শ্রোতা, হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।

এই সময়ে আলোকচিত্রশিল্পীরা হয়ে ওঠে বৃষ্টির অনুবাদক। তারা ধরে রাখে সেই মুহূর্তগুলো—ভেজা করিডোর, ছায়া মাখা মুখ, কিংবা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছায়ামূর্তি।

রাজশাহী কলেজের বর্ষা একটি ঋতু নয়, এটি এক সম্পূর্ণ অনুভূতি। এক শিল্প-সম্মেলন, যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস আর মানুষের হৃদয় একসাথে মঞ্চস্থ হয়। প্রতিটি ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী এমনকি আগন্তুকের মনেও এই শ্রাবণ রেখে যায় দীর্ঘস্থায়ী এক অনুকরণ।

বর্ষাকালীন রাজশাহী কলেজ নিছক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, এটি হয়ে ওঠে ইতিহাসের কোলে বসে থাকা এক অসাধারণ সৌন্দর্যের প্রতীক—যা চোখে দেখা যায়, কিন্তু তার আসল রূপ অনুভব করা যায় শুধু হৃদয়ের ভিতর।

 

রাজু

×