ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

হত্যা মামলার পরও আইইউটিতে ভিসি পদে বহাল রফিকুল ইসলাম, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৯:৩৮, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪

হত্যা মামলার পরও আইইউটিতে ভিসি পদে বহাল রফিকুল ইসলাম, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (আইইউটি)। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) ভুক্ত রাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন পড়াশুনা, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের এগিয়ে নিতেই গাজীপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় আইইউটি।

অভিযোগ রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক’ এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ওআইসির একটি সাবসিডিয়ারি অর্গান হওয়াতে যার কারণে ওআইসির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সবসময় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হতো। 

ভারত পালিয়ে যাওয়া পতিত স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি পদে নিয়োগ পান রফিকুল ইসলাম। শেখ হাসিনা ওআইসির সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার অভিপ্রায়ে এবং ওআইসির রিপ্রেজেন্টিটিভের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়টির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। 

ভিসি ও তার ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বহু দুর্নীতির কথা জানান শিক্ষার্থীরা। জানা যায় জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যার দায়ে মামলা করা হয়েছে ভিসি রফিকের বিরুদ্ধে। 

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির মেকানিক্যাল ও প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পিকনিকে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আইপিই প্রোগ্রামের তিন শিক্ষার্থী- মীর মোজাম্মেল হোসেন, মুবতাসিম রহমান, জোবায়ের আলম মৃত্যুবরণ করেন। 

এ ঘটনার পর আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন,  দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন মেকানিক্যাল ও প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের  বিভাগীয় প্রধান ও সিন্ডিকেটের প্রধান সদস্য প্রফেসর হামিদ তার অব্যবস্থাপনার দায় স্বীকার না করে উলটো সেটা শিক্ষার্থীদের উপর চাপানোর চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরা এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মূলত এর রেশ ধরেই সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শুরু হয়েছে শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলন। 

শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই আন্দোলন মূলত বিশ্ববিদ্যালয়টির সংস্কারের আন্দোলন। হত্যা মামলায় অভিযুক্ত বর্তমান ভিসি এবং ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে সেগুলো ঠিক করা। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীরা তাদের কিছু প্রাথমিক দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেন। যার মধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষকদের প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং আইইউটি থেকে বহিষ্কারের দাবিও আছে। শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি এখনো উত্থাপন করেননি কিছু সাংবিধানিক ঝামেলা এড়াতে যেগুলো তারা পরবর্তীতে জনসম্মুখে আনবেন বলে জানা গেছে। 

দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ ও ভুল বক্তব্য প্রদানের জন্য শিক্ষার্থীরা প্রফেসর হামিদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম, ওএসডব্লিউ (অফিস অব স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার) প্রধান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবু রায়হান, মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. আরাফাত আহম্মেদ ভুঁইয়া, ইলেকট্রিকাল ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রেজাউল হক খানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে সরে যাওয়ার দাবি জানান। অভিযুক্ত শিক্ষকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক দায়িত্বগুলো থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি মেনে নিলেও শিক্ষার্থীদের অনিচ্ছাসত্বেও ফ্যাকাল্টি হিসেবে থাকার বিষয়ে অনড়।

ভিসি রফিকুল ইসলামের কার্যকালে ছয়জন আইইউটিয়ান এর মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছে লাল স্বর্গ। একজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে, একজন আইইউটি লেক এর পানিতে ডুবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শহিদ জাহিদুজ্জামান তানভীন এবং দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে সবগুলোতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজশাহীতে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী, তখন গণমাধ্যমে খবর আসে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের শুরুতে ‘ইসলামিক’ শব্দটা দেখে তাকে ছাত্রশিবির সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়। অথচ এর পরেও বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে অথবা ওআইসি থেকে কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। 

জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহিদ তানভীনের জন্য বিচারের দাবিতেও বিবৃতি দিতে সক্ষম হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা শহিদ তানভীনের স্মৃতিস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি স্থাপনার নাম পরিবর্তনের দাবি তুললেও বিশ্ববিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভিসির এবং সিন্ডিকেট সদস্যদের ফ্যাসিস্ট সরকারের থাকা পূর্ব সম্পর্ককে এর পেছনে দায়ী বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা তাদের অহংবোধ থেকে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য সকল শিক্ষার্থীদের ফলাফল ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ করিয়ে দিত। 

ভিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সিন্ডিকেটের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কারণে, ভিসি দ্বিতীয় মেয়াদে পুনর্নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। 

গত ২৮ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে তাদের দাবি ঘোষণা করে এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীরা ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাব বর্জন করবে বলে ঘোষণা দেন। 

এ সব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে আইইউটির প্রটোকল অফিসার মেহদী হাসান বলেন, যে হত্যা মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এ বিষয়ে স্যারের কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় স্যারকে ভয়ভীতিও দেখানো হয়েছে। যার জন্য থানায় জিডি করা হয়েছে। 

আইইউটি থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হয়েছে। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম পেশাদারিত্ব, সততা এবং দক্ষতা বজায় রেখেছেন। তিনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তার সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া যে অভিযোগ বা গুজব ছড়ানো হচ্ছে তা সত্য এবং পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে নয় এবং সমাজ এবং অ্যাকাডেমিয়া তার মর্যাদা এবং মর্যাদাকে কলঙ্কিত করার জন্য একটি আগ্রহী মহলের ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। 

সম্প্রতি বিদ্যুতায়িত হয়ে নিহত তিন শিক্ষার্থীর বিষয়ে তিনি বলেন, স্যার বিষয়টি নিয়ে মর্মাহত।

এসআর

×