
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ সময়গুলো ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে যায়। চাকরির প্রস্তুতি, ক্লাস-পরীক্ষাসহ নানা দায়িত্ব এসে পরে একসঙ্গে। তবুও থেমে থাকে না আড্ডা কিংবা ঘোরাঘুরি। করোনায় অনেক দিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। হঠাৎ টং দোকানে চায়ের কাপ হাতে বন্ধুরা বলে, ‘কোথাও ঘুরতে যাওয়া হোক। পরিকল্পনাও করে। মিডটার্ম শেষে ঘুরতে যাওয়ার।’
কিন্তু সে বার আর যাওয়া হয়নি! পরে তানজুম, বীথি, লিমা, টুছি ও মতিউর ঠিক করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাছে কোথাও যাওয়ার। গন্তব্য বেছে নেয় সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরের জেলা টাঙ্গাইল। সকাল ৭টায় রওনা হওয়ার কথা হলেও বাসে যখন উঠি তখন ঘড়িতে ১১টা বাজে। তার পরও ৩ জন বাকি রয়ে যায়। পরের বাস ধরে রওনা দেয় আতিক, মতিউর ও মীম। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে টাঙ্গাইলের মহেরা জমিদার বাড়িতে বিজয়, রুকু, ইশরাতসহ ৭ জন পৌঁছে যাই।
মহেরা জমিদার বাড়িটি মূলত চারটি ভবনে বেষ্টিত। মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ ও কালীচরণ লজ। বাড়িটি মোট ৮ একর জমির ওপর অবস্থিত। জমিদার বাড়ির সামনেই রয়েছে বিশাখা সাগর নামে বিশাল এক দীঘি। বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ২টি সুরম্য গেট। ভবনের পেছনে রয়েছে পাসরা পুকুর ও রানী পুুকুর।
ব্রিটিশ সরকার জমিদার প্রথা চালু করলে কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহার পুত্ররা করটিয়ার ২৪ পরগনার জমিদারদের নিকট থেকে এটি বিপুল অংশ পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে নেন। শুরু হয় জমিদারী শাসন ও শোষণ। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ মোহন সাহার উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পর্যায়ক্রমে জমিদারী পরিচালনা করেন। এসব শাসকগণ এলাকায় স্কুল, কলেজ, দাতব্য চিকিৎসালয় ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং পানির ব্যবস্থাসহ অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে জমিদার শাসন বাতিল হয় এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মূল জমিদারদের অধিকাংশই ভারত চলে যান।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রাসাদ কমপ্লেক্স এ প্রবেশ করার জন্য কালীচরণ লজ আর চৌধুরী লজের সামনে রয়েছে দুটি সিংহ দরজা। মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমে চোখে পড়বে কালীচরণ লজের সামনে চোখ ধাঁধানো নকশার একতলা ভবন যা বর্তমানে মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ভবনের সঙ্গে কালীচরণ লজ এমন জ্যামিতিক বিন্যাসে তৈরি করা হয়েছে, দূর থেকে দেখলে একে কালীচরণ লজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হয়। এই মিউজিয়ামে প্রতীকী হিসেবে মুঘল আমলের পুলিশ কর্মকর্তা থেকে বর্তমান সময়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাস্কর্য তৈরি করে রাখা হয়েছে। জমিদার আমলে ব্যবহৃত তৈজসপত্র সুন্দর করে সাজানো আছে এখনও।
চৌধুরী লজের পেছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গায় রয়েছে একতলা আরেকটি ভবন, যা বর্তমানে অতিথি ভবন নামে পরিচিত। ভবনটির সামনের দিকে অনুচ্চ স্তম্ভের ওপরে নির্মিত ত্রিফয়েল আর্চ যুক্ত প্রবেশদ্বার আছে। অলঙ্করণের দিক থেকে আনন্দ লজটিকে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়। প্রাসাদের সম্মুখভাগে দোতলা পর্যন্ত লম্বা ছয়টি কোরাস্থির স্তম্ভ, সামনের দিকে দু’পাশে কারুকাজ করা দুটি ভ্যানিসীয় ঝুল বারান্দা, ছাদের রেলিং এবং কার্নিশে ফুলের মালা আর জ্যামিতিক অলঙ্করণ প্রাসাদটিকে অনুপম সৌন্দর্যম-িত করে তুলেছে। দু’পাশের বারান্দার ওপরে প্যাঁচানো ধাঁচের লোগো দেখে মনে হয় এটি মহেরা জমিদারীর সিল। জমিদার বাড়ির সর্ব পশ্চিমের ভবনের নাম মহারাজ লজ। এই লজ হচ্ছে সর্ববৃহৎ স্থাপনা, যা ছিল জমিদার গজেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরীর আবাসন। ১২টি কক্ষ নিয়ে ভবনটি স্থাপিত। সবাই একসঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করি। মূল ফটকের পরেই দেখা যায় চৌধুরী লজের। পাশাপাশি আছে আরও দুটি লজ। ভবনগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। একটি ভবন দেখা শেষে আরেকটি ভবনে যেতে থাকি। পুলিশের প্রশিক্ষণ চলায় লজের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। দৃষ্টিনন্দন লজগুলো দেখা শেষে পাসরা ও রানী পুকুর পারে খানিকটা বিশ্রাম করি। পুকুরের পাশেই আছে রঙিন মাছে ভরা এ্যাকুরিয়াম। আরও রয়েছে লোহার তৈরি টেবিল ও চেয়ার। জাদুঘর দেখে মহেরা থেকে বেরিয়ে পড়ি। তখন দুপুর ৩টা। এবারের গন্তব্য ২০১ গম্বুজ মসজিদ। বীথির ব্যস্ততা থাকায় সে বিদায় নেয়। গোপালপুরে বন্ধু ইমরানের বাড়ি। মসজিদে যাওয়ার আগে ইমরানের বাড়িতে যাই এবং তাদের রাইস মিল পরিদর্শন করি। পরে দুপুরের খাবার সেরে নেই। বেলা ডুবে গেছে। অটোরিকশায় চেপে পৃথিবীর সর্বোচ্চ গম্বুজের মসজিদে পৌঁছে যাই। রাত হয়ে যাওয়ায় আক্ষেপ থাকলেও এই মসজিদ এনে দেয় প্রশান্তি। কারুকার্যে পরিপূর্ণ বিশাল এই মসজিদ এখনও নির্মাণাধীন। রাতের শেষ বাসে ক্যাম্পাসে ফিরি। এখানেই গণবিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ষষ্ঠ ব্যাচের সফর সমাপ্ত হয়।