
.
একটা সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালো অবস্থানে ছিল অগ্রণী ব্যাংক। কিন্তু খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ঘাটতি ছাড়াও নানা অনিয়মে জর্জরিত হয়ে পড়ে ব্যাংকটি। ২০০৪ সাল থেকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা এবং অগ্রণী ব্যাংকও এর বাইরে নয়।
খেলাপি ঋণ কমিয়ে ব্যাংকটিকে ফের এক নাম্বারে আনতে পরিস্থিতি উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। জনকণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ২০২৪ সালে ৩ সেপ্টেম্বর থেকে নতুনভাবে এই দায়িত্ব তার কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ সালে ১২ ফেব্রুয়ারিতে গ্রেড-১ অফিসার হিসেবে প্রথম চাকরিতে যোগদান করেছিলাম। ঠিক তখনও আমার (আইবিএ) পড়শোনা শেষ হয়নি। ঠিক ৬ মাস চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। বাংলাদেশ ব্যাংকে ডিজি-১ পদে যোগদান করি। এর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দেশের মধ্যে শুরু হয়ে গেল অস্থিরতা।
পাকিস্তান আর্মি আমাদের ১৭ জনকে তুলে নিয়ে যায়। রুমি, ক্রিকেটার বুলবুল, জুয়েল বদিকে নিয়েছে কাওরানবাজার থেকে, রাজারবাগ থেকে আমাকে ও আলতাফ মাহমুদকে। মগবাজার থেকে নেওয়া হয়েছে আজাদ ও বাসারকে। আমাকে হাতের নোখ ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ তুলে ফেলে। ওরা আমাকে জানে মারেনি। আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি। ওরা এগারো জন সিনেমার ঘটনাটিতে আমার বক্তব্য তুলে ধরা আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি করা অবস্থায় ৭৪ সনে চলে যাই সেন্ট্রাল ব্যাংক অব দ্য ইউনাইটেড আরব আমিরাত (ইউএই)। তখন বেতন পাই দেড় লাখ টাকা। সেখানে ২১ বছর কাজ করি। ফের ঢাকায় আসি এবি ব্যাংকে যুক্ত হই এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
এরপরে প্রাইম ব্যাংকে যুক্ত হই ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে। দুই বছর পর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হই। এরপরে অগ্রণী ব্যাংকে যুক্ত হলাম। আমি ২০০৪ সালে অগ্রণীতে যুক্ত হই। তখন ব্যাংকটির খেলাপি ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। সার্বিকভাবে তা লোকসানে ছিল। ইক্যুইটি নেগেটিভ, ক্যাপিটাল শটফল ছিল, এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ওভারকাম করাটাই আমার প্রধান শর্ত।
আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, প্রতিটি বোর্ড কিংবা ম্যানেজমেন্টের জন্য খেলাপি ঋণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখানেও আমরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। যখন আমি ২০১০ সালে ছেড়ে গিয়েছিলাম, তখন খেলাপি ঋণ ৩৮ থেকে ১১ শতাংশের নিচে নামিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি, এটি আবার বেড়ে ২৮ শতাংশ হয়েছে। এই খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ ডান কিংবা বাম পাশ দিয়ে ঋণ দিয়েছে বটে, কিন্তু তা আর ফলোআপ করা হয়নি।
তবে এখানে আমার কাজ হবে, খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য নিয়মিত তদারকি করা। ব্যাংকের মুনাফা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যখন ২০০৪-এ ছিলাম, তখন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে বলেছিলাম, মূলধন আমার আয় দিয়ে পরিপূর্ণ করব। তা ২০১০ সালে করেছিলামও। কিন্তু এখন আবার ঘাটতি বেড়ে গেছে। এটিও আমার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
চাকরির প্রথম দিনেই আমি বাধাপ্রাপ্ত হই। পরে আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে বলি কোন ব্র্যাঞ্চ বন্ধ করার পক্ষে আমি নই। সাড়ে ৮শত ব্র্যাঞ্চের মধ্যে ৪ শত ব্র্যাঞ্চ লোকসানের মধ্যে ছিল। আমি একটা কথা দিয়েছিলাম কোনো কর্মী ছাটাই করা হবে না। আমি সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করেছি।
ব্যাংকটির তথ্যমতে, অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের চিত্র ২০০৪ সাল থেকে বেশ ওঠা-নামা করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮,০৯৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের একটি বড় অংশ।
২০১০ সালে অগ্রণী ব্যাংকের মোট সম্পদ ছিল ২৬,৪৮৫ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে ১,২৩,০৯৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই সময়ে সম্পদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৬৫ শতাংশ, তবে মুনাফা কমেছে শীর্ষ ২০ জন ঋণখেলাপির কাছে অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় ৮,৮৯৯ কোটি টাকা আটকে আছে, যা মোট খেলাপি ঋণের ৩৩ শতাংশ। ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনর্তফসিল করা। আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, এবার যখন চেয়ারম্যান হিসেবে আসলাম এখন দেখি আরও কঠিন অবস্থা।
খেলাপি দেখি ফের ৪০ শাতাংশে কাছাকছি। যে সকল কোম্পানির কথা চিন্তাই আসে না। তারাই দেখি লস মেকিং এ আছে। প্রিন্সিপাল ব্র্যাঞ্চে এখন যাকে দায়িত্বে আনা হয়েছে আসা করছি সেপ্টেম্বর এর মধ্যে ভালো সংবাদ পাওয়া যাবে। সঠিক নির্দেশনা ও পলিসির আলোকে অনেক পরিবর্তন আসবে বলে জানান তিনি। তবে খেলাপিদের বিরুদ্ধে এখনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদেরকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। গত ১৫ বছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা ক্লাসিফায়েড অ্যাকাউন্টে লোকসান রয়েছে। ব্যাংকের ডেফারেল লস ১৫ হাজার কোটি টাকা রয়েছে বলে জানা গেছে।
আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, অগ্রণী ব্যাংককে এগিয়ে নিতে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। তবে চ্যালেঞ্জ যাই আসুক, ব্যাংককে এগিয়ে নিতে সবার প্রথমে ইচ্ছা থাকা জরুরি। সেই ইচ্ছা থাকলে আমাদের নির্ধারিত স্থান পৌঁছানো সম্ভব হবে।
তবে তার আগে আমাদের তিনটি জিনিস থাকা বাধ্যতামূলক। সেগুলো সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি যা থাকলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক এক নম্বর হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে ভালো প্রতিযোগিতা হতে পারে। তবে আমার লক্ষ্য, অগ্রণী ব্যাংক যেন দেশের এক নম্বর ব্যাংক হয়, আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়।
প্যানেল মজি