ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ

বাণিজ্যিক শর্তে ছাড় দিতে চায় ঢাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৩০, ২২ জুলাই ২০২৫

বাণিজ্যিক শর্তে ছাড় দিতে চায় ঢাকা

.

ওয়াশিংটনের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে অ-বাণিজ্যিক কোনো শর্তে রাজি হবে না ঢাকা। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত বাস্তবায়নে ৫ থেকে ১০ বছর সময় চাওয়া হবে।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত পারস্পরিক শুল্ক চুক্তির জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়ে (ইউএসটিআর) নিজেদের খসড়া অবস্থানপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তৃতীয় দফা বৈঠকের জন্য ঢাকার অনুরোধে ওয়াশিংটন এখনো সাড়া দেয়নি। 
আমেরিকান পণ্যকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কমানোর আশা করছে সরকার। সম্প্রতি সচিবালয়ে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা হয়।

ওই বৈঠকে এক ডজনের বেশি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো ও নীতিগত সমন্বয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, বৈঠকে ভিয়েতনামের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির তুলনায় ভিয়েতনাম ১২২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত রপ্তানি করেও শুল্কের হার ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে  নামিয়ে আনতে পেরেছে। তাই বাংলাদেশের জন্য শুল্কের হারও এর কাছাকাছি হবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে শুল্কবাবদ বাংলাদেশ বছরে ৬৪৮ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পাল্টা শুল্ক) কমাতে রাজি হলে বাংলাদেশ এসব শুল্কের পুরোটাই ছাড় দিতে রাজি হবে। তবে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন সংক্রান্ত ‘রুলস অব অরিজিন’ শর্তে বাংলাদেশ ছাড় পাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আন্তঃমন্ত্রণালয় এ সভায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবসহ প্রায় এক ডজন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, আমরা খুব শীঘ্রই আলোচনার জন্য যেতে চাচ্ছি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র মিটিংয়ের সময় এখনো নিশ্চিত করেনি। তাদের তো অনেক দেশের সঙ্গেই মিটিং করতে হচ্ছে। তাই তাদের প্রিপারেশন (প্রস্তুতি) নিতে সময় লাগছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত চুক্তির ডকুমেন্টের প্রেক্ষাপটে এ সপ্তাহেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত পজিশন পেপার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর- ইউএসটিআরে পাঠানো হবে। তার আগে তৃতীয় রাউন্ড তথা চূড়ান্ত নেগোসিয়েশনের জন্য মিটিংয়ের সময় চেয়ে তাদের ই-মেইল করা হবে।

বাণিজ্য সচিব আরও বলেন, বাংলাদেশের মূল পজিশন পেপার আগেই পাঠানো হয়েছে। এখন চূড়ান্ত নেগোসিয়েশন (আলোচনা) শুরুর আগে আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং করে আরও কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করছি। এই খসড়া পজিশন পেপার এ সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর পর তাদের দেওয়া সময় অনুযায়ী মিটিংয়ে নেগোসিয়েশন করা হবে। ‘নেগোসিয়েশনে চুক্তির বিভিন্ন শর্তে দু’পক্ষ সম্মত হলে খসড়া চুক্তি উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন ও আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে স্বাক্ষর করা হবে’। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নিয়ে দাবিগুলো নজিরবিহীন বলে ব্যবসায়ী নেতাদের যে উদ্বেগ সে বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘১৯৪৯ সালের পর সারাবিশ্বে এ ধরনের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ কখনো আসেনি। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কখনো এই সংকট দেখিনি। এতদিন উন্নত দেশগুলো শুল্কমুক্ত কোটামুক্ত সুবিধা দিয়ে গরিব দেশগুলোকে সহায়তা করত, এবার যুক্তরাষ্ট্র সেখানে প্রথমবারের মতো  রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ আরোপ করেছে।

কর্মকর্তারা আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গমের পাশাপাশি সয়াবিন, বিভিন্ন তৈলবীজ, ডাল, চিনি ও বার্লি আমদানি বাড়ানোর পক্ষে সম্মতি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। যার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গতকালই সরকারিভাবে দেশটি থেকে বছরে সাত লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িং কোম্পানির উড়োজাহাজ, এলএনজি, সামরিক সরঞ্জাম আমদানি বাড়ানোর পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট (চিকিৎসা সরঞ্জাম) আমদানি বাড়ানোর শর্ত দেওয়া হয়েছে।

যার প্রতিক্রিয়ায়, এসব আমদানি বাড়াতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ডাক্তারদের অ্যাসোসিয়েশন ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিকারকদের থেকে লিখিত মতামত নিয়েছে। যেহেতু চীনের তুলনায় এসব পণ্যের আমদানি ব্যয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি হবে, সেজন্য প্রতিযোগী সক্ষমতা নিশ্চিতে আমদানিকারকরা সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চেয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া, বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি প্রোটেকশন (আইপি) ও জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) এর আন্তর্জাতিক কনভেশন মানে না বলে অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। প্রস্তাবিত বাণিজ্য চুক্তিতেও এসব বিষয়ে শর্তারোপ করেছে দেশটি। 
সভায় শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ভারতসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশও পুরোপুরি আইপি প্রোটেকশন মানতে পারে না। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে এই মুহূর্তে শতভাগ আইপি প্রোটেকশন মানা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে এক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের অঙ্গীকার করবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। 
সরকারি কেনাকাটায় যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে সুবিধা দেওয়ার জন্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস সংশোধন করার পাশাপাশি জি-টু-জি ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো, এবং বাংলাদেশে ব্যবসারত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর মুনাফা, রাজস্ব ও মূলধন দ্রুত ছাড় করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে মার্কিন কোম্পানিগুলো কোনো বাধার সম্মুখীন হলে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে সেগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে সমাধান করা হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হবে। 
 

প্যানেল মজি

×