ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

তরল সোনা

আগর ও আতর

আবুল ফজল মো. আবদুল হাই

প্রকাশিত: ২০:২২, ১৪ জুন ২০২৫

আগর ও আতর

পাহাড়-টিলা অধ্যুষিত সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বেশি চা-বাগান রয়েছে মৌলভীবাজার জেলায়। এখানকার চা শিল্পের পাশাপাশি আরেকটি বিশেষ শিল্পের খ্যাতি দেশজুড়ে। সেটি হলো আগর ও আতর শিল্প। আতরকে তরল সোনা বলা হয়ে থাকে। আতর অ্যালকোহলমুক্ত সুগন্ধি। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে এ সুগন্ধির চাহিদা বলতে গেলে আকাশছোঁয়া।
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলাকে বলা হয় আগর-আতরের আঁতুড়ঘর। এই শিল্পের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। আগর-আতরকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে অনুমোদন দিয়ে এরই মধ্যে জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। 
বাংলাদেশে আগর শিল্পের ইতিহাস এই সুজানগর পুরোটা দখল করে আছে। এই জনপদ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কাঁচা আতর মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। চাহিদা ভালো থাকায় প্রচুর পরিমাণে আগর কাঠও রপ্তানি হচ্ছে। এসব কাঠ ধূপের মতো জ্বালিয়ে সুগন্ধি তৈরি করা হয়। মৌলভীবাজার জেলায় ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করছে আগর-আতর। এ খ্যাতি সেই মোগল আমল থেকে। আগরগাছ থেকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে আতর তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হয়, যার সুঘ্রাণ ছড়িয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। বড়লেখা উপজেলার সুজানগরকে বলা হয় আগরের রাজধানী। বাগান তৈরির পাশাপাশি বসতবাড়ির আশপাশেও গাছ লাগানো হয়। বাণিজ্যিকভাবে আগরের চাষ বেড়েছে এ অঞ্চলে। এই শিল্পের সঙ্গে মৌলভীবাজারের ৪০-৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই গড়ে উঠেছে কারখানা। গ্রামের পথ ধরে হাঁটলেই নাকে আসবে আগর-আতরের সুঘ্রাণ। বাড়ির উঠানের এক পাশে ফালি ফালি করে কাটা হচ্ছে আগর গাছ, আরেক পাশে চলছে কাটা টুকরো থেকে পেরেক খোলার কাজ। ঘরের বারান্দায় বসে নারীরা করছেন ফালি কেটে ছোট টুকরা করার কাজ। কারখানায় শ্রমিকরা সারি বাঁধা ডেকচিতে আগর জ্বাল দিচ্ছেন। জ্বাল দেয়া কাঠের টুকরো থেকে সনাতন প্রক্রিয়ায় যে নির্যাস বের করা হবে তা আতর তেল। 
সুজানগরে প্রায় ২৫০টি ছোট ও মাঝারি আগর-আতর কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানে রয়েছে আরও প্রায় ৫০টির মতো। জেলা থেকে বছরে আনুমানিক ৫ হাজার লিটার কাঁচা আতর এবং ১০-১৫ হাজার কেজি আগরকাঠ বিদেশে রপ্তানি হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পরিপক্ব আগরগাছের প্রতি কেজি কাঠ ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। আর সাধারণ কাঠ মানভেদে ২০০ থেকে হাজার টাকায়। একেকটি কারখানায় মাসে ১-৫ লিটার তরল আতর উৎপাদিত হয়। 
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগর থেকে আতর সংগ্রহের পদ্ধতিটি সনাতন। প্রাকৃতিকভাবে আগরগাছে সৃষ্ট ক্ষতে কষ জমে। গাছের ক্ষতস্থান কেটে তা জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় সুগন্ধি আগর। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে গাছে কখন ক্ষত হবে এজন্য অপেক্ষা করতে হতো বছরের পর বছর। প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদনের চাহিদা পূরণ করা ছিল অসম্ভব। তাই এখানকার বাসিন্দারা আবিষ্কার করেন বর্তমানে লোহার পেরেক মারা পদ্ধতি। ফলে সাত-আট বছরের মাথায় একটি আগরগাছ থেকে এখন আগর-আতর উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।  
আগরগাছ লম্বায় প্রায় ১৫-৪০ মিটার এবং বেড় বা ব্যাস শূন্য দশমিক ৬ থেকে ২ দশমিক ৫ মিটার হয়। শাখা-প্রশাখবিহীন সোজা লম্বা গাছটি দেখতে এবং আকার আকৃতিতে অনেকটা শাল বা গজারি গাছের মতো। সাদা রঙের আগর কাঠ খুব নরম হয়। ফলে আতর উৎপাদনের উপকরণ সংগ্রহ ও জ্বালানি কাঠ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার হয় না।  
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সিঙ্গাপুর আগর ব্যবসার মূলকেন্দ্র। প্রধান প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া অন্যতম।
বড়লেখা আতর-আগর ব্যবসায়ী আনসার মিয়া বলেছেন, তাদের রপ্তানির পরিমাণ বছরে ১০০ কোটি টাকার উপরে। তাদের তৈরি আতর সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ ছাড়াও ইউরোপে রপ্তানি হচ্ছে। বিদেশে আতরের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও তারা সে অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছেন না। আবার যতটুকু উৎপাদন করছেন, তাও সরবরাহ করতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগর ক্লাস্টারকে দেশের রপ্তানি পণ্যের শীর্ষে নিয়ে আসা সম্ভব বলে জানান তিনি।  
আগর-আতর ব্যবসায়ী জসিম আহমদ বলেছেন, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আতর উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাছাড়া এখানকার কারখানাগুলো অনেক ছোট, সবার পক্ষে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে রপ্তানিও সম্ভব হচ্ছে না। সরকার বড়লেখায় আগর-আতর গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করলে উপজেলাবাসী আরও বেশি রপ্তানি করতে পারতো। 
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বে অব বেঙ্গল পারফিউমারির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আবদুল কবির জানান, তাদের ১০-১২ বিঘা জমিতে আগর বাগান রয়েছে। কারখানায় ৮০ জন লোক কাজ করেন। ১৮টি মেশিনে মাসে গড়ে ৫০০ তোলা (এক তোলা আতর ১১ দশমিক ৬২ গ্রাম) আতর উৎপাদিত হয়। তরল আতর ও আগর কাঠ মিলে প্রতি বছর বিদেশে আড়াই লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে তাদের প্রতিষ্ঠান। মধ্যপ্রাচ্যের সুগন্ধি প্রস্তুতকারক ও আতরের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে কাঁচা আতর ক্রয় করে। 
বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, মৌলভীবাজার জেলা থেকে প্রতি বছর এ খাতে ৫০০-৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। আনুমানিক পাঁচ হাজার লিটার কাঁচা আতর এবং ১০-১৫ হাজার কেজি আগর কাঠ বিদেশে রপ্তানি হয়। শুধু বড়লেখায় বছরে প্রায় চার হাজার লিটার আগরের নির্যাস উৎপাদন হয়। বর্তমানে প্রতি লিটার তরল আতর ৬ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ লাখ টাকা দরে রপ্তানি হয়। 

প্যানেল

×