
আসছে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বাজেট
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা সংকটের মুখে কয়েক বছর ধরেই চাপের মুখে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে ডলার সংকট ও শুল্ককরজনিত নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি। আগামী বছরের মধ্যে এলডিসি উত্তরণ পরিস্থিতি, রপ্তানিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কারোপ এবং সর্বশেষ স্থলপথে পণ্য রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়টি সামনে রেখেই আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২ জুন সোমবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে (বিটিভি) নতুন প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন। এর পরের দিন মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বাজেট নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন অর্থ উপদেষ্টা।
জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পরই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। এরই পদক্ষেপ হিসেবে ভোজ্যতেল, চাল, চিনিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য আমদানিতে প্রায় শতভাগ শুল্কছাড় দেওয়া হয়। এছাড়া আমদানি-রপ্তানিতে এলসি সুবিধা প্রদান ও ডলারের জোগান বাড়ানোর নির্দেশনা দেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে। তবে এখনো মূল্যস্ফীতি স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বর্তমান ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মুনসুর এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, আগামী বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেই বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা হবে।
জানা গেছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বেশকিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতি রয়েছে। নতুন বাজেট ঘোষণার আগে অর্থনীতিতে আটটি বড় চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাজেট সামনে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রস্তুতি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি ও আলোচনা এবং শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো প্রধান চ্যালেঞ্জ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অর্থনীতি কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সংকট এবং দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সংকটে শিল্প উৎপাদন ও বিনিয়োগ স্থবিরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্ষোভের ফলে কলকারখানার উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকরী বাজেট প্রণয়নে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষকে বাজারে স্বস্তি দিতে আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই প্রধান অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের চলমান আটটি কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ এবং কিছু ক্ষেত্রে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি বুঝতে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি অন্যতম নির্দেশক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এনবিআরকে আদায় করতে হবে। এনবিআরবহির্ভূত কর এবং কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে যা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে করা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) মাত্র ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা কম। আগামী বাজেটে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম অটোমেশনসহ শুল্কছাড় ও কর অব্যাহতি কমিয়ে আনাসহ নতুন বেশ কিছু খাতে ভ্যাট ও কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী বাজেটে প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। করের হার না বাড়িয়ে ভিত্তি বাড়াতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব আহরণ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়াসহ বর্তমানের সার্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটও উচ্চাভিলাষী। বাস্তবায়নযোগ্য করার জন্য আরও ছোট করা উচিত।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে না, সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া হবে মহার্ঘ ভাতা ॥ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, কোনো খাতেই কোনোভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে না। কালো টাকার উৎস বন্ধে আমি চেষ্টা করছি, যে দামে জমি কেনাবেচা হয় সে দামেই হবে জমির নিবন্ধন বা দলিল। এক্ষেত্রে করও কমানো হবে। এত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে কি না জানি না। গুলশানে প্রতি কাঠা জমি ১৫ কোটি টাকায় বিক্রি হলেও দলিল হয় ৫ কোটি টাকায়।
এভাবে কেনাবেচায় দু’পক্ষই বিপদে পড়েছে। অনেকে ঘুষটুষ দিয়ে এখান থেকে পার পাচ্ছে। আমরা এ প্রবণতা বন্ধ করতে চাই। সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বিষয়ে বিশেষভাবে বিবেচনা করছে সরকার। এ বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে বলেও জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, মহার্ঘ ভাতা নিয়ে এখন কিছু বলার সময় আসেনি। একটা কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছি। তারা কাজ করছেন, সেটা করে আমার কাছে দেবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগামী অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কাজ হচ্ছে। ভাতা দিলে আগামী অর্থবছরে বাড়তি কত খরচ হবে তার হিসাব-নিকাশ হচ্ছে।
এর আগে গত ডিসেম্বরে ‘মহার্ঘ ভাতা’ সংস্থানের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে সরকার। পর্যালোচনা শেষে কমিটি গ্রেডভিত্তিক ১০ থেকে ২০ শতাংশ ভাতা দেওয়ার সুপারিশ করে। গত জানুয়ারি থেকেই এ ভাতা কার্যকরের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সংকটকালীন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই সময় এ উদ্যোগের সমালোচনা করেন অর্থনীতিবিদরা। এমন প্রেক্ষাপটে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া থেকে তখন পিছিয়ে যায় সরকার।
সামাজিক নিরাপত্তার আওতা ও সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমকে জোরদার করা হবে ॥ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে পেনশনযোগ্য বয়স হলে জমাকৃত অর্থ এককালীন তোলার সুযোগ, প্রবাস ও প্রগতি স্কিমে সর্বনিম্ন মাসিক চাঁদার পরিমাণ কমানো, প্রগতি স্কিমে মাসিক সর্বোচ্চ জমার পরিমাণ বাড়ানো, আউটসোর্সিং সেবা চুক্তিতে নিয়োজিত কর্মীদের পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ইসলামিক ভার্সন চালুর প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া ইত্যাদি। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের দ্বিতীয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি ॥ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানান, আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন দিয়েছে এনইসি। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। প্রায় সব খাতেই বরাদ্দ কমছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতও। উল্লেখ্য, এডিপি’র আকার ব্যাপক পরিমাণে কমানো হচ্ছে। এবার কমছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপির আকার হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য পরে তা কমিয়ে আনা হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুসারে আগামী এডিপির অর্থের মধ্যে স্থানীয় উৎস থেকে জোগান দেওয়া হবে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আর প্রকল্প সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। আগামী এডিপিতে ১ হাজার ১৪২টি প্রকল্প রয়েছে। এডিপিতে বরাদ্দের দিক থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতকে। এ খাতে মোট ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে শিক্ষা খাতে। এ খাতে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দের পরিমাণ ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।