
দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করতে ছায়া হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক
দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করতে ছায়া হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের আমলে দেশে ১০টি ব্যাংক দুর্বল হিসেবে প্রকাশ পায়। তখন থেকেই ব্যাংক খাতের আমানতকারীদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি হয়। এই ব্যাংকগুলোকে টেনে তুলতে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। রউফ তালুকদারের দেখানো পথে বেশি দূর এগোতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরপর বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর যেন আগুনে ‘ঘি’ ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ করেন। তিনি বলেন, ১০টি ব্যাংক শুধু দুর্বলই নয়, বরং কার্যত দেউলিয়া দশায় পৌঁছে গেছে। তার এ বক্তব্য ব্যাংকিং খাতের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এবং গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অনেক দুর্বল ব্যাংক আস্থা হারিয়ে ফেলে।
অনেকে মনে করছেন গভর্নরের এমন বক্তব্য কোনো অনুমানের ভিত্তিতে নয়, বরং তার কাছে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু তথ্য রয়েছে, যা সংকটের গভীরতা নির্দেশ করে এবং ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাংক অবসায়ন বা বন্ধ হয়ে গেলে আমানতকারীরা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ফেরত পাবেন। অর্থাৎ কেউ যদি কোনো বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাংকে ১০ লাখ বা ৫০ লাখ টাকা রাখেন তিনি কেবল ২ লাখ টাকা ফেরত পাবেন। ৯৫ শতাংশ গ্রাহকের স্বার্থ নিশ্চিতকরণে গভর্নর আমানতকারীদের এভাবে নামমাত্র সাহস জোগান।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে চলমান সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও সুস্পষ্ট ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে কোন ব্যাংকগুলোর অবস্থা সংকটাপন্ন, কোনটি টিকে থাকবে তা নির্দিষ্টভাবে বলা না হলে পুরো খাতে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে।
সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে সরকারের পক্ষ থেকে একীভূতকরণ এবং অধিগ্রহণ, পুনঃমূলধনীকরণে আইনগত প্রয়োগের জন্য ব্যাংক রেজুল্যুশন আইন জারি করা হয়। মূলত ব্যাংকগুলোকে ভালো করার স্বার্থে এই আদেশ জারি করা হয়। অধ্যাদেশ অনুযায়ী অকার্যকর বা অতি দুর্বল ব্যাংককে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নিতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে কোনো ব্যাংক আর কার্যকর নয় বা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই, দেউলিয়া হয়ে গেছে বা দেউলিয়া হওয়ার পথে রয়েছে, আমানতকারীদের পাওনা দিতে পারছে না বা না দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখন এ ধরনের ব্যাংককে ভালো করার স্বার্থে নতুন অধ্যাদেশ অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এ বিষয়ে বিশেষ নীতিমালা তৈরি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে ৫-১০ বছর সময় লাগতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে বসছি। তাদের সবকিছু নজরদারি করছি। ইতিমধ্যে আমরা তাদের অনেক তারল্য সহায়তা দিয়েছি। তবে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে এসব ব্যাংকের ৫ থেকে ১০ বছর প্রয়োজন। আমাদের দেশে যেসব ব্যাংক খারাপ অবস্থা থেকে উঠে এসে ভালো করেছে তাদেরও মোটামুটি এমন সময়ই লেগেছে।’ দুর্নীতির কারণে দুর্বল হওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছয়টি ব্যাংক অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত ছয় মাসে আমানত সংগ্রহ ও গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে এসব ব্যাংক এগিয়ে গেছে।
ঘুরে দাঁড়ানো ছয়টি ব্যাংক হলোÑইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আইএফআইসি ব্যাংক ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। এসব ব্যাংকের বেশিরভাগই এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল নয়। সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতি সহায়তার ফলে এগুলো তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তবে নতুন উদ্বেগের বিষয় হলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। আগে গোপন থাকা বিপুল পরিমাণ মন্দ সম্পদ (ঋণ) এখন প্রকাশ পাচ্ছে, যা ব্যাংকগুলোর লাভজনকতায় বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে বাকি পাঁচটি ব্যাংক এখনো আমানতকারীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে এবং আমানত উত্তোলনের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে নতুন টাকা ছাপানো বন্ধ করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তারল্য সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ পাঁচটি ব্যাংক এখনো প্রতিদিন তারল্য সহায়তার জন্য আবেদন করে যাচ্ছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর তারল্য সহায়তা কর্মসূচিও কার্যকারিতা হারিয়েছে। কারণ এ কর্মসূচির আওতায় ঋণ নেওয়া কিছু ব্যাংক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে গ্যারান্টি প্রকল্পের অধীনে সাতটি সংকটাপন্ন ব্যাংককে ২৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে এখনো ৭ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ফলে গ্যারান্টি প্রকল্পের আওতায় অন্য কোনো ব্যাংক এখন এসব সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইতোমধ্যে এ প্রকল্প বন্ধের পরামর্শ দিয়েছে। কারণ এটি ব্যাংক খাতকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। ঋণ কার্যক্রম স্থগিত থাকায় এসব ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমানত উত্তোলন পরিচালনার জন্য এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থের ওপর নির্ভর করছে। কারণ এ ব্যাংকগুলো এখনো গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়াসহ সংস্কারের জন্য নতুন অধ্যাদেশ জারি করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হাসান বলেন, ‘তালিকায় থাকা ১১টি দুর্বল ব্যাংকের মধ্যে ৬টি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাকি ৫টি সংকটে রয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করতেই যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে আসলে তা নয়। আমরা পেছন থেকে ছায়া হয়ে কাজ করতে পারব। অধ্যাদেশ জারি হয়েছে এটা ঠিক; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নিয়ে ঢেলে সাজানো বা অন্য ব্যাংকগুলোকে ধরে ধরে রাষ্ট্রীয়করণ করব। রাষ্ট্রের এই বোঝা বহন করার সামর্থ্য নেই। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু মিডিয়া হয়ে কাজ করবে।’