ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৩ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সন্তানের জীবন বাঁচাতে এক নিষিদ্ধ জননীর জীবনযুদ্ধের গল্প

শেখ ফয়সাল আহমেদ কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা মিরপুর

প্রকাশিত: ০২:২৫, ২৩ মে ২০২৫

সন্তানের জীবন বাঁচাতে এক নিষিদ্ধ জননীর জীবনযুদ্ধের গল্প

পৃথিবীতে "মা" একটি পবিত্র শব্দ, একটি নির্মল পরিচয়। এই পরিচয়ে কোনো কলঙ্ক লাগে না। জীবনের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মা কখনো সন্তানকে ছেড়ে যায় না। নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েও মা সন্তানের জন্য লড়ে যান, তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শেখান। সমাজের নানা স্তরে ছড়িয়ে থাকা নিষিদ্ধ পেশায় নিযুক্ত অনেক নারী আছেন, যারা বাইরের দৃষ্টিতে "যৌনকর্মী", কিন্তু ভেতরে তাঁরা একজন পরিপূর্ণ মা—সন্তানের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক।

রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে সংসদ ভবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সন্ধ্যা নামতেই ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের দেখা মেলে। তাদের একজন আসমা আক্তার (ছদ্মনাম), ৩৪ বছর বয়সী, টাঙ্গাইলের কালিহাতীর এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং সৎ মায়ের অমানুষিক নির্যাতনের মধ্যে আসমার বেড়ে ওঠা। পড়াশোনার সুযোগ পাননি। অল্প বয়সেই বিয়ে হয় ইউসুফ নামের এক রিকশাচালকের সঙ্গে, যিনি বিয়ের পর তাঁকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। দুই বছর পর তাঁদের ঘরে জন্ম হয় এক প্রতিবন্ধী কন্যা সন্তানের।

এই সন্তানের জন্মই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায় আসমার জীবনে। রাগ ও হতাশায় স্বামী ইউসুফ আসমাকে ফেলে চলে যান। বাবাও তখন দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। অচেনা শহরে, প্রতিবন্ধী সন্তানকে কোলে নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সাহায্য চাইতে থাকেন আসমা। কোন উপায় না পেয়ে আগারগাঁওয়ের একটি বস্তিতে আশ্রয় নেন। সেখানে পরিচয় হয় শেফালী নামের এক নারীর সঙ্গে, যিনি তাঁকে যৌনকর্মী হওয়ার প্রস্তাব দেন।

মেয়েকে পাশের বাসার এক নারীর কাছে রেখে এক সন্ধ্যায় আসমা নিজের দেহ বিসর্জনের যাত্রা শুরু করেন। প্রথম দিনেই শিকার হন একাধিক পুরুষের শারীরিক নির্যাতনের। রক্তাক্ত হয়ে ফিরলেও তাঁর মুখে ছিল বিজয়ের হাসি, কারণ সেদিনকার আয় দিয়ে তিনি কিনেছিলেন সন্তানের জন্য দুধ।

আজও সেই পেশাতেই রয়ে গেছেন আসমা। কখনো ৫০০, কখনো ২০০০ টাকা আয় হয়—তবে তা নিশ্চিত নয়। অনেক সময় মারধর, যৌন নিপীড়ন এবং ঠকির শিকার হন। ভুলবশত অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন কয়েকবার, গর্ভপাত করাতে হয়েছে।

আসমা বলেন,
"অনেক রাতের পর রাত দুধের শিশুর কথা ভেবে পুরুষদের পায়ে ধরে কেঁদেছি—ছাড়তে বলেছি। কেউ শোনেনি। তবে ভালো মানুষও আছে, যারা খাবার খেতে দেয়, বকশিশ দেয়। কিন্তু সংখ্যাটা খুব কম।"

১৮ বছর বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে আছিয়া (ছদ্মনাম) প্রায়ই অসুস্থ থাকে, ব্যয়বহুল ওষুধ লাগে। আসমাও অসুস্থ থাকেন প্রায়ই।
"আমি ছাড়া মাইয়াডার আর কেউ নাই। সবচেয়ে কষ্ট লাগে, আমি যখন থাকবো না, তখন মাইয়াটার কী হবে?" – বলতে বলতে চোখে তাঁর টপটপ করে পানি ঝরে।

কোনো এনজিও বা সরকারী সহায়তা কখনও পেয়েছেন কি না—জানতে চাইলে বলেন,
"লজ্জা লাগে আমার এই কাজের কথা কাওরে বলতে। আর যারা সাহায্যের কথা বলে, তারাও সুযোগ নিয়ে দেহে হাত দেয়। কেউ কিছু দেয়নি। চাকরি পাবো কই? লেখাপড়া তো করিনি। মাইয়ার চিকিৎসা চালাতে গিয়েই এই পথ।"

আসমার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজের চোখে যাঁরা "পাপিষ্ঠ", তাঁরা আসলে কেউ কারও মা, কেউ বোন—এবং তাদের হৃদয়েও ভালোবাসা, ত্যাগ, মমতা রয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা হাজারো ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীর জীবনে আসমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের উচিত এসব নারীর তালিকা তৈরি করে স্বাস্থ্যসেবা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। তাহলেই তারা মর্যাদাপূর্ণ জীবনে ফিরতে পারবে।

একটি রাষ্ট্র বা সমাজ নারীকে অবহেলা করে কখনোই শক্তিশালী হতে পারে না। নিষিদ্ধ পথে পড়া মায়েদের জন্য দরকার ঘৃণা নয়—ভালোবাসা ও সহানুভূতি।

এসএফ

×