
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচায
অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান সময়ে দেশে চোরতন্ত্রের উত্থান হয়েছে এবং আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ চলছে বলে মনে করেন দেশের রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজ। সোমবার গুলশানের হোটেল লেকশোরে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৫-২৬ : নীতি সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে আমলারা সহায়তা করেছিল তারা ৫ আগস্টের পরেও বহাল তবিয়তে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচাযের সভাপতিত্বে সংলাপে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, মূলত আমলারা দায়িত্ব পালন করছে। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে তারাই আছে। দেশের এখন যে পরিস্থিতি সেখানে আমলারা নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এখন না আছে নির্বাচিত সরকার আর না আছে কোন রোডম্যাপ যেটার ওপর নির্ভর করে মানুষ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
ফলে এখানে আমলাতান্ত্রিকতাই চিরস্থায়ী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুই ভাগে বিভক্তিকে স্বাগত জানালেও এনবিআরের নীতিমালা সরাসরি আমলাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি একে উদ্বেগজনক হিসেবে মন্তব্য করেন। আমীর খসরু বলেন, এনবিআরের পলিসি ও কালেকশনের যে ভাগ সেটা দরকার ছিল। কিন্তু নীতিমালা প্রণয়নে আমলাদের জড়িত করে সরাসরি তাদের হাতে নীতিমালা তুলে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু নীতিমাল প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন করের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যেখানে বাংলাদেশের মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভরশীল, সেখানে আমলাতন্ত্রের ওপরে যারা সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ তাদের প্রয়োজন ছিল। ব্যুরোক্রেসি অবশ্যই থাকবে, কিন্তু তাদের দায়িত্ব হবে টেকনিক্যাল কোনো সমস্যা আছে কি না, আইনগত সমস্যা হচ্ছে কি না, সেটা চিহ্নিত করা। পলিসি তৈরি তাদের কাজ না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যপরিধির প্রতি ইঙ্গিত করে এ সরকারের উদ্দেশে আমীর খসরু বলেন, এখন মানবিক করিডরের কথা বলছেন। এটি সেনসেটিভ ইস্যু, বাংলাদেশের সিকিউরিটির প্রশ্ন। জিও স্ট্যাটিজিক ডিসিশন। আপনারা তো এই ডিসিশনের দিকে যেতে পারেন না। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে ডিসিশনে যাচ্ছেন। একটা নন-পলিটিক্যাল গভর্নমেন্ট, একটা ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের কি এসব সিদ্ধান্তে যাওয়ার দরকার আছে?
দেশে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রায় একই কথা বলেন অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। দেশের আমলাতন্ত্র আরও শক্তিশালী হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চোরতন্ত্রে ছিলেন আমলারা, ব্যবসায়ীরা আর রাজনীতিবিদরা। ৫ আগস্টের পর রাজনীতিবিদরা পালিয়ে গেছেন, ব্যবসায়ীরা ম্রিয়মাণ আর আমলারা পুরো শক্তি নিয়ে পুনরুজ্জীবিত।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এনবিআর নিয়ে বর্তমানের যে আলোচনা চলছেন সে বিষয়ে বলতে বলব- দুই ভাগ করা ঠিক আছে। এটা আমাদের শ্বেতপত্রে সুপারিশে ছিল। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, সেটা ঠিক হয়নি। আলোচনা ব্যতিরেকে, পেশাজীবীদের জায়গা সঙ্কুচিত ও অন্যান্য অংশীজনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে করা হয়েছে, এটা ঠিক হয়নি। এটাকে এখন ঠিক করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি আমরা পরিসংখ্যান দেখি তৃতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি কমেছে, ঋণ প্রবাহ তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, এফডিআই কমেছে ও পুঁজিবাজারের সকল সূচক নি¤œমুখী। এই অবস্থায় কর্মসংস্থান কিভাবে হবে? বেকারত্বে হার বেড়েছে ৪ শতাংশের বেশি। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি, অর্থাৎ তাদের প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে।
তাহলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, এটা এখন জোর দিয়ে বলতে পারছি না। জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে আছে। এটা বাড়াতে হবে। আগামী অর্থবছরেও ১০ এর নিচে থাকছে। পরোক্ষ করের বৃদ্ধির হার বেশি। তার মনে হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপরই করের বোঝা বাড়ছে।
বাজেটে ব্যয়ের তথ্য উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, রাজস্ব ব্যয়ের দুটি খাত সবচেয়ে বেশি হচ্ছে- প্রথমটি সুদ ব্যয় আর দ্বিতীয়টি ভর্তুকি। সরকারের অর্থনীতি পরিচালনা কোনো ঘোষিত নীতিমালার আলোকে হচ্ছে না, তা চলছে এডহক ভিত্তিতে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার দুর্বলতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য মুদ্রানীতি এখনো প্রতিফলিত হয়নি। ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে এলে আমরা একটা সিগন্যাল পাব। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যুব দারিদ্র্য বাড়ছে এটা বলা বাহুল্য।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারের বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়টি আমাদের নজরে রেখেছেন। টাস্কফোর্স থেকে বলেছি দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করা দরকার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকার আসলেও তারা অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলায় যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারে নাই। যে ফিসক্যাল পলিসি নিয়ে কাজ হচ্ছে, সেটাও কিন্তু গত সরকারের।
পুরানো যে কাঠামো রয়েছে সেটাকেই ধুয়ে-মুছে কাজ করা হচ্ছে, সেটা আমাদের পছন্দ হয়নি। টাস্কফোর্সের যে সুপারিশ ছিল, সেটা ধরে যে গতি আসার কথা ছিল, তা আমরা দেখতে পাইনি। বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ-মিয়ানমার দিয়ে জটিলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, একইভাবে বৈষয়িক অর্থনীতির পরিস্থিতিও খুবই জটিল। বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাপনা খুবই সংকটের মধ্যে আছে। এই সংকটের মধ্যেই আগামীর বাজেট করতে যাচ্ছে সরকার।
সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অনিসুজ্জামান চৌধুরী তার বক্তব্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক যাত্রার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তিনি ‘বাস্কেট কেস’ ধরনের পুরানো, নেতিবাচক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে দেশের উন্নয়ন ও সক্ষমতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার ওপর তিনি জোর দেন। পাশাপাশি, স্থিতিশীল ও ন্যায্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামোর অনুপস্থিতির দিকটি তুলে ধরেন, যা আজকের দিনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
অনুষ্ঠানে রামরুর প্রতিষ্ঠাতা ও ক্যালেন চেয়ারপারসন ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, মালয়েশিয়ায় আবার শ্রমবাজার খুলতে যাচ্ছে, কিন্তু পুরানো ব্যবস্থাতেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এতে বড় পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। প্রবাসী আয় বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। এত বছর ধরে এ কথাটি বলা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ৪০টি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান করা হলেও সেখানে প্রশিক্ষক দেওয়া হয়নি। তিনজন করে অন্য জায়গা থেকে দেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়।
বিআইডিএসএর মহাপরিচালক ড. এনামুল হক বলেন, এ সরকারের এটিই একমাত্র বাজেট হলেও, আগামী বাজেটে ৫ আগস্টে তৈরি হওয়া মানুষের প্রত্যাশা ও লক্ষ্যের দিকনির্দেশনা দিয়ে যেতে হবে।