বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে এবার ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরেছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে এবার ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরেছে। এ ছাড়া রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধির ফলে রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে নতুন করে ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। তাই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ করার কারণে এখন থেকে ধীরে ধীরে রিজার্ভের উন্নতি হবেÑ এমন প্রত্যাশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাব মান অনুযায়ী ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৩৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৫২ কোটি ২১ লাখ ডলার। এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জানিয়েছেন, প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধিতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে। গত জুলাই থেকে আগস্টে রেমিটেন্সের প্রবাহ বেড়েছে।
আর্থিক সংকট কাটতে শুরু করায় ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলার কেনাবেচা করতে পারছে। এ ছাড়াও তিনি বলেন, ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ক্ষয়রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। কারণ রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি ঘটছে। গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জুলাইয়ের সঙ্গে আগস্টের প্রবৃদ্ধি ধরলে এটা প্রায় ৯০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চলতি সেপ্টেম্বর মাসের দুই সপ্তাহে ১১৬ কোটি ৭২ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে) ১৪ হাজার ৬ কোটি টাকার বেশি। সে হিসাবে প্রতিদিন আসছে ৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার করে। এভাবে রেমিটেন্স আসার ধারাবাহিকতা থাকলে চলতি মাসে আড়াই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি রেমিটেন্স আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই রেমিটেন্স আসার গতি ভালো রয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাসটিতে আড়াই বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স আসতে পারে। বৈধ পথে রেমিটেন্স আসার পেছনে সচেতনতা কাজ করছে। আবার বৈধ পথে ডলারের দরবৃদ্ধিতে হুন্ডি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তারা। এতে বাড়ছে রেমিটেন্স আসার গতি।
তবে ডলার বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামে খোলা বাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলার লেনদেন নেই। নির্ধারিত দরের চেয়ে ২-৪ টাকার ব্যবধান রয়েছে। জোগানের চেয়ে চাহিদার ঘাটতি থাকায় বাড়তি দরে ডলার বেচাকেনা হয় মানি এক্সচেঞ্জের পার্শ্ববর্তী গলিপথ কিংবা হোটেল-রেস্তোরাঁয়। দরদাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সরেজমিনে ঢাকার মতিঝিল দিলকুশা, ফকিরাপুল, পল্টন এলাকায় এসব চিত্রের দেখা মিলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার রেমিটেন্স ও আন্তঃব্যাংক ডলারের রেট ছিল ১২০ টাকা। আর খোলা বাজারের ক্রয় দর নির্ধারণ করা ছিল না। কিন্তু সর্বোচ্চ বিক্রয় দর ছিল ১২১ টাকা। সরেজমিন রাজধানীর মানি এক্সচেঞ্জগুলোর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে ডলার নেই বলা হচ্ছে। তবে দোকান থেকে বের হলেই পাশে অপেক্ষমাণ অপরিচিতরা ডলার কেনাবেচার প্রস্তাব দেন। তারা বেশি দামে গলিপথ বা হোটেল রেস্তোরাঁয় ডলার বিক্রি করছেন। এভাবেই ডলার কিনে ঠকছেন অনেকে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজার মনিটরিং কমে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে অবৈধ ডলার সিন্ডিকেট বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। বিক্রেতারা বলছেন, ডলার সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে বাজার ওঠানামা করছে।
ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১২১-১২৪ টাকা পর্যন্ত দরে তারা ডলার কিনছেন। তবে সমস্যা হলো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না, কিনতে হচ্ছে দালালের কাছ থেকে।
মানি এক্সচেঞ্জগুলোর কয়েকটিতে ডলার কেনা ১২০ ও বিক্রি ১২১ টাকা লেখা থাকলেও বিক্রির কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি। ক্রেতা দেখলেই দোকানের বাইরে নিয়ে দরদাম চালাচ্ছে কিছু ব্যক্তি। মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এম এস জামান বলেন, ‘খোলা বাজারে ডলারের জোগান আগের চেয়ে কমেছে। এখন চাহিদামতো ডলার পাওয়া যাচ্ছে না।
এজন্য বাজার বিষয়ে নতুন গভর্নরকে কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। আশা করি পরিস্থিতি দ্রুতই উন্নতি হবে।’রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ ॥ রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমরা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। অন্যদিকে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে।
ডলারের বাজার স্থিতিশীল আছে। এ ছাড়া আইএমএফসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকেও সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস মিলেছে। ফলে এখন আর রিজার্ভ কমবে না। ধীরে ধীরে বাড়বে। মূলত ২০২২-২৩ অর্থবছরের পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোতে ডলার বিক্রি করতে শুরু করে। কারণ ডলার সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংকগুলো আমদানি বিল মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল।
ফলে দেশের রিজার্ভ বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে নেমে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে।