ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বৈশাখী অর্থনীতি

জলি রহমান

প্রকাশিত: ০১:০৩, ২১ এপ্রিল ২০২৪

বৈশাখী অর্থনীতি

বাংলা নববর্ষ শুরু হলেই দেশের অর্থনীতিতে দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন আবহ

বাংলা নববর্ষ শুরু হলেই দেশের অর্থনীতিতে দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন আবহ। শুরু হয় বর্ষবরণের নানা আয়োজন। আর এ আয়োজনকে কেন্দ্র করে বাড়ে আর্থিক প্রবাহ। বৈশাখী মেলা, হালখাতা সবই যেন বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। পাশ্চত্য মিশেলে মানুষের জীবনযাপনে পরিবর্তন এসেছে সত্য। তবে ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির রীতিনীতি চলছে আগের মতোই। শুধু এসব সংস্কৃতি পালনের ধরনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। 
হালখাতা : প্রায় দুই দশক আগের কথা, আমাদের বাড়ির কাছেই একটি মুদির দোকান ছিল। সবাই চিনত দেলোয়ারের দোকান নামে। প্রতি বাংলা বছর শুরুর প্রথম দিন দোকান থেকে শোনা যেত গানের শব্দ। দোকানে কেউ গেলেই খাওয়ানো হতো জিলাপি। আর যারা বাকিতে কেনাকাটা করতো তাদের ঘরে চৈত্রের মাঝামাঝিতে পৌঁছে দিত হালখাতার চিঠি।

এভাবেই গ্রামবাংলায় পহেলা বৈশাখের আগমনী বার্তা পাওয়া যেত। আজকাল শহরের দোকানে হালখাতার তেমন গুঞ্জন না শোনা গেলেও গ্রামে এখনো বেশ ধুমধাম করেই পালন করা হয় হালখাতার উৎসব। সারা বছর বহু লোক নানা পণ্যসামগ্রী দোকান থেকে বাকিতেই কিনে থাকেন। আর দোকানদাররাও টাকা পেতে  তেমন জবরদস্তি করেন না। একটি খাতায় সবার নাম ও হিসাব থাকে লিপিবদ্ধ।

আর বছর শেষে পাওনাদারসহ আরও যারা কেনাকাটা করেন সবাইকে চিঠি পাঠিয়ে করা হয় নিমন্ত্রণ। এতে অংশগ্রহণ করেন ক্রেতাসহ সাধারণ মানুষও। পাওনাদারদের দোকানের পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার উৎসবমুখর এ আয়োজনকে বলা হয় হালখাতা। দোকানের পক্ষ থেকে সবাইকে খাওয়ানো হয় মিষ্টান্ন। গ্রামীণ বাংলার অর্থনীতিতে এ উৎসবের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের দোকান মালিক সমিতির হিসাব মতে, দেশের বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র দোকানি ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করে থাকেন।

এ জাতীয় দোকানের সংখ্যা দেশে মোট ২৫ লাখের মতো। প্রতিটি দোকানে যদি গড় খরচ ১০ হাজার টাকা হয়, তাহলে মোট খরচ হবে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সুতরাং পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশের অর্থনীতিতে লেনদেন হবে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। 
বৈশাখী মেলা : রাজধানীর রামপুরায় হচ্ছে বৈশাখী মেলা। সেখানে কথা হলো বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি পণ্যের কারিগর মকবুল মিয়ার সঙ্গে। বললেন সারা বছরই তিনি বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করেন। তবে বৈশাখী মেলায় তার বিকিকিনি হয় অনেক ভালো। মকবুল মিয়ার মতো অনেকেই বৈশাখী মেলায় অধিক বিক্রির আশায় বাড়তি অর্থ বিনিয়োগ করেন পণ্য তৈরিতে। আবার বিক্রিও হয় ভালো।

বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য বৈশাখী মেলা। এ মেলার উৎসবের দিক চিরচেনা। গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে বিশাল মাঠে, পথের পাশের স্বল্প পরিসর স্থানে আয়োজন করা হয় এ মেলার। নানান পণ্যের পসরার পাশাপাশি থাকে বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, দোলনাসহ নানা রাইডের ব্যবস্থা।

কুমোরেরা বসেন মাটির পুতুল, ঘোড়া, বর-কনে ও হাতিসহ নানা শিল্পকর্ম নিয়ে। রঙিন পোশাকে সুসজ্জিত নর-নারী, বালক-বালিকা, উচ্ছ্বসিত আর উৎফুল্লিত শিশুর দল-সবই যেন বৈশাখী মেলার অংশ। মিষ্টি বিক্রেতারা বসেছেন মিষ্টি, লাড্ডু, বাতাসা, জিলাপি, কদমা নিয়ে কিংবা শিল্পীরা দোকান সাজিয়েছেন ডালা, কুলা বা বেতের ঝুড়ি দিয়ে, সবকিছুতেই বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি জড়িয়ে আছে। 
বৈশাখী মেলার অর্থনৈতিক দিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই মেলা উপলক্ষে নতুন কর্ম-নিয়োজনের সুযোগ সৃষ্টি হয় কুমোর, ময়রা, তাঁতি, বাঁশ-বেত শিল্পীদের জন্য । নতুন করে বিনিয়োগ হয় নানান ক্ষেত্রে,  সৃষ্টি হয় আয়ের বিভিন্ন খাত।

গ্রামের নারীদের জন্যও বৈশাখী মেলা নানা মাত্রিক আর্থিক সুফল বয়ে আনে। সারা বছর ধরে তাদের বানানো পাটি, ছোট ছোট ঝুড়ি ও টুকরি, পটসহ হরেক পণ্য বাড়ির পুরুষদের মাধ্যমে পাড়ি জমায় বৈশাখী মেলায়। তাঁতি-বৌয়েরা যে সব গামছা, ছোট্ট শাড়ি তৈরি করেন তাও প্রবেশ করে এ মেলায়। সদ্য রবিশস্য থেকে প্রাপ্ত আয় নিয়ে ক্রেতারা আসেন মেলায়। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যোগ হয় নতুন মাত্রা।

×