ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১০ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

এক বছর পর কমল ডলারের দাম ॥ রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের পালে সুবাতাস

অর্থনীতি ফের বেগবান হচ্ছে 

রহিম শেখ

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ২৩ নভেম্বর ২০২৩

অর্থনীতি ফের বেগবান হচ্ছে 

অর্থনীতি ফের বেগবান হচ্ছে 

ডলার সংকটে বেশ কিছুদিন ধরে আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছিলেন না ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন আমদানিকারকরা। এমন পরিস্থিতিতে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা ডলারের দামে লাগাম পরিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় এক বছর পর ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ২০২১ সালের আগস্টের পর থেকে ডলারের বিপরীতে কমতে থাকা টাকার মান প্রথমবারের মতো শক্তিশালী হলো। আগামী মাসের শুরুতে ডলারের দাম আরেক দফা কমানোর চিন্তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে এখন উদ্বৃত্ত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ডলার জমা রাখার হার বেড়েছে, কমেছে বাণিজ্য ঘাটতি। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোয় বৈদেশিক দায় শোধের চাপও কিছুটা কমে এসেছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসায় রিজার্ভের ওপর চাপও কমে এসেছে। বৃহস্পতিবার দিনশেষে চাহিদা ও জোগান মিলিয়ে বর্তমানে দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলারের দাম কমা ছাড়াও অর্থনীতির জন্য আরও সুখবর অপেক্ষা করছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮১ মিলিয়ন বা ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের পালে লেগেছে সুবাতাস। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি আবার বেগবান গতি পেতে যাচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। 
জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নানা উদ্যোগের পরও ডলার সংকট কমছে না। এমন অবস্থায় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দর ঠিক করে আসছে। প্রথমে রপ্তানিতে ৯৯ টাকা এবং রেমিট্যান্সে ডলার কেনার দর ১০৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কেনার দর অভিন্ন করা হয়। যদিও বেশির ভাগ ব্যাংক নির্ধারিত দরে ডলার না পেয়ে বেশি দিয়ে কিনছে। ডলারের বাজারে অস্থিরতার মধ্যে সেই থেকে ক্রমাগত ডলারের দর বাড়িয়ে আসছিল সংগঠন দুটি।

দর বাড়ানোর হার বেশি হয়ে যাচ্ছে কি না এমন সমালোচনা মধ্যে গত বুধবার ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে এবার ভিন্ন কৌশল নিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমানো হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারে পাওয়া যাবে ১১০ টাকা। আর আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির করা হবে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায়, যা আগে ছিল ১১১ টাকা। তবে প্রবাসী আয়ে সরকারের দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকও একই পরিমাণ প্রণোদনা দিতে পারবে। ফলে প্রবাসী আয় পাঠালে ডলারপ্রতি সর্বোচ্চ ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা পাবেন উপকারভোগীরা। বাফেদা ও এবিবি নেতারা মনে করছেন, ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রেখে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

আমদানিতে ডলারের বাড়তি দামের ফলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। আর এর ফলেই কমছে না মূল্যস্ফীতির পারদ। বাফেদা এবং এবিবির সদস্যরা সবাই এই সিদ্ধান্ত মেনে আমদানি ব্যয় মেটাবেন বলে জানিয়েছেন বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আফজাল করিম। তিনি বলেন, ডলার দাম বাড়া-কমার যে বিষয়টা বাজারে আমরা দেখি, সেটা অনেকটাই কৃত্রিম। আফজাল করিম বলেন, রেমিটেন্স বাড়ছে। বাণিজ্য ঘাটতি বেশ কমেছে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট- বিওপি) ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। তাই আমরা ৫০ পয়সা করে কমিয়েছি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে পর্যায়ক্রমে আরও কমানো হবে জানিয়ে বাফেদার চেয়ারম্যান বলেন, আশা করছি ডলারের বাজার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, এখন থেকে আর প্রতি মাসে ডলার কেনাবেচার দর বাড়ানো হবে না। তিনি বলেন, বৈদেশিক লেনদেনে আর্থিক হিসাবে ঘাটতিই এখন বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে ইতোমধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমে এসেছে। বেশির ভাগ ব্যাংকের নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) ইতিবাচক হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশী ব্যাংকের কাছে বকেয়া কমে এসেছে। এদিকে ডলারের দাম লাফ দিয়ে যেভাবে বেড়েছিল, ঠিক সেভাবেই লাফ দিয়ে দাম পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি একেএম ইসমাইল হক। তিনি বলেন, চলতি সপ্তাহে ডলারের দাম নেমে এসেছে। খোলা বাজারে ডলারের দাম লাফ দিয়ে বেড়েছিল, সেভাবেই কমছে। আমার বিশ্বাস, ডলারের দাম আরও কমবে। 
এদিকে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপও কমে আসছে। চাহিদা ও যোগান মিলিয়ে বর্তমানে দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ‘অক্টোবরের তুলনায় চলতি মাসে প্রবাসী আয়ের গতি বেশি। তাই বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ায় চাহিদা ও দামের মধ্যে ভারসাম্য ফিরতে শুরু করেছে। জোগান ও চাহিদার ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন (বাফেদা) যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা সঠিক। 
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসায় বিদেশী ব্যাংকের কাছে বকেয়াও কমেছে। এখন আর্থিক হিসাবে ঘাটতিই, বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফিতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিসেম্বর নাগাদ মূল্যস্ফীতি আট শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেগুলো ইতিবাচক দিকে যাওয়া শুরু করেছে। আর্থিক সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরছে।
তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি শক্তিশালী করতে যে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ইতিবাচক দিকে যাওয়া শুরু করেছে। আর্থিক সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরছে। 
এদিকে ডলারের দাম কমা ছাড়াও অর্থনীতির জন্য আরও সুখবর অপেক্ষা করছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮১ মিলিয়ন বা ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, দ্বিতীয় কিস্তির শর্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঋণ চুক্তিতে থাকা বাংলাদেশের প্রথম কিস্তির অর্থ ব্যবহারের অগ্রগতি দেখে পরবর্তী কিস্তি ছাড়ের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া গত অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে।

এই সময়ে বিশ্বব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তাসহ মোট ৯ প্রকল্পে ৩.৬০ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর আগে কোনো অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এত বেশি প্রতিশ্রুতি পায়নি বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ১.৮৮ বিলিয়ন ডলার। জাপানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি এসেছে ১.৫১ বিলিয়ন ডলার। এসব অর্থ ধাপে ধাপে পাচ্ছে বাংলাদেশ। 
এদিকে বছরের মাঝামাঝি কমে আসা রেমিট্যান্সে আবারও গতি ফিরেছে। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেি টেন্স। আর এই রেমিটেেন্স সুবাতাস লাগায় অর্থনীতি আবার চাঙ্গাভাবে ফিরবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা। গত অক্টোবরের পর নভেম্বরেও রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১৭ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা ১১৯ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। গত বছর নভেম্বরের ১৭ দিনে এসেছিল ১০০ কোটি ডলার।

জানতে চাইলে অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের যেহেতু রেমিটেন্স বাড়ছে, সেটা সুখবর আনবে। সামনে নির্বাচন। এখন যদি অর্থনীতির গতিপথ অব্যাহত না থাকে সেটা জনগণের সামনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলত। ঠিক সময়ে আমরা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে দেখছি- মন্তব্য করে তিনি বলেন, আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ বড় একটা গ্রিন সিগন্যাল। বৈশ্বিকভাবে আমরা ভালো সংবাদ দিতে পারব। আর সেটা রিজার্ভের নিরাপত্তার জন্য খুব ভালো হবে বলে তিনি মনে করেন।

×