
ময়ূর যখন পেখম মেলে ধরে। তখন তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন না, এমন মানুষ কমই আছে। শখে দুই একজন ময়ূর পালন করতেন। এখন তা আমাদের দেশে পেশা হিসাবে নেয়ার সময় এসেছে। এই করোনাকালে ঢাকা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ৮৮টি ময়ূর বিক্রি করেছে। প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ময়ূর লালন-পালনের উপযোগী। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পাখিটি গ্রামের মানুষও স্বাচ্ছন্দ্যে লালন-পালন করতে পারবে। ঢাকা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জোড়াপ্রতি ময়ূরের দাম রেখেছে ৫০ হাজার টাকা। পাঁচ মাসে ২২ লাখ টাকার ময়ূর বিক্রি করা হয়েছে। কেউ শখে, কেউ বা বাণিজ্যিকভাবে পালনের জন্য ময়ূর ক্রয় করেন বলে জানা যায়। বিভিন্ন রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ ময়ূর কিনে নিয়েছে। ময়ূরের মাংস হালাল। খেতে ও অনেক সুস্বাদু। তবে এখন দেশে ময়ূরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। এক সময় হয়ত এটা সর্বজনীনভাবে অন্যান্য প্রাণীর মাংসের মতো খাওয়ার প্রচলন হবে। মাছ ধরা ছিপের সঙ্গে ময়ূরের পালক ব্যবহার করা হয়। পালক দিয়ে তৈরি করা হয় মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ, বিভিন্ন অলঙ্কার, টেবিল ম্যাট, ওয়াল ম্যাট, নকশা করা হাতপাখাসহ নানা ধরনের শোপিস। ময়ূরের পালকের তৈরি গাউন অনেক উন্নত দেশে বিশেষভাবে পরিচিত। এই গাউনের সঙ্গে পালকের তৈরি বিভিন্ন গহনাও পরা হয়। ময়ূরের পায়ের চামড়া দিয়ে তৈরি হয় ঘড়ির বেল্ট, চাবির তোড়া ও মানিব্যাগ।
সাধারণত ময়ূর নীল, সাদা, সবুজ রঙের হয়। নীল জাতের ময়ূর সহজে পোষ মানে। তবে এদের খুব একটা দেখা যায় না। এর গলা গাঢ় নীল রঙের। দেখতে অপূর্ব। এর শরীরের পালকগুলোর অধিকাংশই ধাতব নীলচে। এটি ১৩০ থেকে ১৫০ সেমি. দৈর্ঘ্যে পেখমসহ ২০০ থেকে ২৩৫ সেমি. পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সবুজ ময়ূর। এরা আকারে বেশ বড় হয়। এ জাতের ময়ূর লম্বায় ১৮০ থেকে ৩০০ সেমি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। পেখম ১৪০ থেকে ১৬০ সেমি.। এদের গলা সবুজ বর্ণের। দেহ কিছুটা খাড়া, মাথার ঝুটিও বেশ লম্বা। পেখম সবুজ ও সোনালি রঙে মেশানো। স্ত্রী-পুরুষ প্রায় একই রকম দেখতে। সাদা ময়ূরের সংখ্যা খুব কম। প্রকৃতপক্ষে জিনগত কারণে নীল ময়ূরই সাদা ময়ূর হয়ে যায়। অন্যান্য ময়ূরের মতোই তাদের আচরণ। এরা মানুষের খুব কাছাকাছি থাকতে পারে। স্ত্রী ময়ূরের পেখম ছোট হলেও মাঝে মধ্যে শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য পেখম তোলে এরা।
পাঁচ-ছয়টি স্ত্রী ময়ূরের সঙ্গে একটি পুরুষ ময়ূর থাকে। এরা মাটিতে চলাফেরা করলেও বেশির ভাগ সময় গাছের ডালে থাকতে পছন্দ করে। বছরে গড়ে ১০-১৫টি ডিম দেয়। ডিম থেকে ছানা ফুটতে ২৭-৩০ দিন সময় লাগে। ময়ূরের গড় আয়ু ১২-১৫ বছর। আবদ্ধ অবস্থায় লালন-পালনের ক্ষেত্রে এদের নিয়মিত গম, ধান, সবজি, বীজ ইত্যাদি খেতে দিতে হয়। পেঁপে, তরমুজসহ অন্যান্য পাকা ফলও এদের প্রিয় খাদ্য। খোলা স্থানে ময়ূর পালন করলে এগুলো উড়ে যাবে, আবার ছোট খাঁচা হলে এরা চলাচল করতে পারবে না। তাই ময়ূর পালনের জন্য অবশ্যই বড় আকারের খাঁচা নির্মাণ করতে হবে। ময়ূর যখন পেখম মেলে তখন তার জন্য প্রায় সাত-আট ফুট জায়গা লাগে, তাই খাঁচার প্রস্থ ৯ থেকে ১০ ফুট হলে ময়ূর সুস্থ ও সুন্দর থাকবে।
ময়ূরের খামার করে সফল হয়েছেন কুমিল্লার শাহ আলী। হোমনা উপজেলার বাবরকান্দি এলাকায় তার খামার। ২০১৯ সালে তিনি এক জোড়া ময়ূর ক্রয় করেন। ওই ময়ুর ২৪টি ডিম দেয়। বাচ্চা হয় সেখান থেকে ১৭টি। ময়ূরের জন্য আলাদা শেড নির্মাণ করেছেন তিনি। ২০২০-২১ সালে তিনি ২০ লাখ টাকার ময়ূর বিক্রি করেছেন। খরচ বাদে তার মুনফা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। প্রায় ৫০ লাখ টাকার ময়ূর তার খামারে রয়েছে। সংখ্যায় যা ১০৫টি।
শাহ আলী বলেছেন, এটা সৌখিন জিনিস। কেউ ভুল করে আগে খামারের পরিকল্পনা করবেন না। শুরুতে দুই-এক জোড়া পালন করে যদি মনে করেন পারবেন, তাহলে খামার করার উদ্যোগ নেয়া উচিত। আমি যেহেতু লাভবান হয়েছি, তারাও হবেন। যে কোন পরামর্শ দিতে আমি প্রস্তুত। এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ নজরুল ইসলাম বলেছেন, শাহ আলীর খামার জেলার একমাত্র ময়ূর খামার। নিয়মিত তার খামার পরিদর্শন ও সার্বিক সহযোগিতা করা অব্যাহত রয়েছে। ময়ূরের পাশাপাশি তিনি গরু, ভেড়া, তিতির পাখি ও কোয়েল পালন করছেন। আগে ব্যক্তি পর্যায়ে ময়ূর ও হরিণ পালনে বাধা ছিল। এখন সে বাধা নেই।