ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে প্রতিবছর ৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার অবৈধ তামাক বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২০ মে ২০১৫

দেশে প্রতিবছর ৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার অবৈধ তামাক বাণিজ্য

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ দেশে প্রতিবছর তামাকের অবৈধ বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং এর ফলে প্রতিবছর ২৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এমনই তথ্য বেরিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন এ্যালায়েন্স (এফসিএ) ও হেলথ ব্রিজ পরিচালিত সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে। তামাকের অবৈধ বাণিজ্যের পথ ধরে দেশব্যাপী বাড়ছে সংঘবদ্ধ চোরাকারবার, মাদকপাচার ও মানবপাচারের মতো ভয়াবহ ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তামাকের অবৈধ বাণিজ্য তামাকজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। গোটা বিশ্বকে দ্রুত তামাক মহামারির দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অন্যদিকে প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) পরিচালিত অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬ শতাংশ সিগারেট-বিড়ি-চুরুট এবং ১৪ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য অবৈধভাবে বিক্রি হয়। মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ইংল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ ৫০টিরও বেশি দেশ থেকে আসা শতাধিক ব্রান্ডের অবৈধ তামাকপণ্যের বাজার এখন বাংলাদেশ। অবৈধ সিগারেট ও চুরুটের অধিকাংশই আসে সমুদ্র ও বিমান পথে। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের প্রায় পুরোটাই আসে স্থলপথে এবং প্রধানত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত তামাকপণ্যেরও একটা অংশ কর ফাঁকি দিয়ে বাজারজাত করা হয়। সংস্থাটি তাদের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজস্ব ক্ষতি ছাড়াও তামাকের অবৈধ বাণিজ্যের ফলে দেশে কেবল কম দামী সিগারেটের সহজপ্রাপ্যতাই বাড়ছে না একই সঙ্গে তামাকপণ্যে আরোপিত করের প্রভাবও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। ফলে তামাকপণ্য ক্রমশ সস্তা হয়ে পড়ায় জনগণ বিশেষ করে তরুণ, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্লোব্যাল এ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে অনুযায়ী (২০০৯), দেশে মাত্র ৫ বছরের (২০০৪ থেকে ২০০৯) ব্যবধানে তামাক ব্যবহারকারীর হার বেড়েছে ৬ শতাংশ (৩৭% থেকে ৪৩%)। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটিরও বেশি। অন্যদিকে তামাকের অবৈধ বাণিজ্যের পথ ধরে দেশব্যাপী বাড়ছে সংঘবদ্ধ চোরাকারবার, মাদকপাচার ও মানবপাচারের মতো ভয়াবহ ঘটনার ঝুঁকি। সূত্র জানায়, তামাকের অবৈধ্য বাণিজ্য একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব বাজারে প্রতি ১০টি সিগারেট শলাকার ১টিই বিক্রি হয় অবৈধভাবে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী সিগারেট বাণিজ্যের ১১ দশমিক ৬ শতাংশই অবৈধ এবং এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে রাষ্ট্রসমূহকে প্রতিবছর ৪০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার রাজস্ব ক্ষতি গুনতে হয়। বাংলাদেশের মতো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এই রাজস্ব ক্ষতির মাত্রা আরও বেশি বলে দি ইউনিয়ন এর ২০০৯ সালের সর্বশেষ এক গবেষণায় বলা হয়েছে। তামাকপণ্যের অবৈধ বাণিজ্যের কারণ হিসেবে গবেষণা প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, তামাকপণ্যের যোগান ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই তামাকের অবৈধ বাণিজ্যর মূল লক্ষ্য। মূলত তিনটি কারণে তামাকের অবৈধ বাণিজ্য সংঘটিত হয়। প্রথমত, দাম-পার্থক্য অর্থাৎ কিছু দেশে তামাকপণ্যের দাম কম এবং কিছু দেশে বেশি হলে। দ্বিতীয়ত, শুল্ক হার ও কর কাঠামোর তারতম্য অর্থাৎ কিছু দেশে নি¤œ কর হার এবং কিছু দেশে উচ্চ শুল্ক হার চালু থাকলে। তৃতীয়ত, দুর্বল সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান থাকলে। এছাড়া কোম্পানিগুলো দেশের অভ্যন্তরে কর ফাঁকি দেয়ার মাধ্যমেও অবৈধ বাণিজ্য করে থাকে। বলা হয়েছে, তামাকপণ্যের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করা গেলে তামাকজনিত মৃত্যু কমবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। দি ইউনিয়নের গবেষণা (২০০৯) অনুসারে, বিশ্বে তামাকপণ্যের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করা গেলে সামগ্রিকভাবে সিগারেটের দাম ৩ দশমিক ৯ শতাংশ বাড়বে এবং বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার ২ শতাংশ কমবে। ফলে বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের জীবন বাঁচানো যাবে, যার মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজারই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের। পাশাপাশি সারাবিশ্বের সরকারগুলোর অতিরিক্ত ৩১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার রাজস্ব আয় অর্জন করতে পারবে। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার আয় হবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সরকারের। এছাড়া এর ফলে তামাকপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকায় তরুণদের তামাক সেবন শুরুর প্রবণতা কমে আসবে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম কমবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় বা গবার্নেন্স সিস্টেমে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ কমে আসবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তামাকের কারণে সারাবিশ্বে বছরে মারা যায় প্রায় ৬০ লাখ মানুষ, যার ৬ লাখই পরোক্ষ ধূমপায়ী। অনতিবিলম্বে এই বিপুলসংখ্যক মৃত্যু ঠেকাতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করা গেলে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এই মৃত্যুর পরিমাণ বছরে ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে এবং এই মৃত্যু টোলের ৮০ ভাগই বহন করতে হবে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৫৭ হাজার মানুষ, পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও ৩ লাখ ৮২ হাজার। (বর্তমানের হিসেবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি) তামাকের অবৈধ বাণিজ্য তামাকজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। গোটা বিশ্বকে দ্রুত তামাক মহামারির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তামাকের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধের উপায় হিসেবে বলা হয়েছে, কর বাড়িয়ে বিদেশী তামাকপণ্যের সঙ্গে দাম পার্থক্য কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। দেশে বিদ্যমান আইন-কানুন কঠোরভাবে প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ। তামাকের অবৈধ বাণিজ্যের স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষতি বিবেচনায় এনে এটি বন্ধে দল-মত নির্বিশেষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসির ১৫ ধারার আলোকে ২০১২ সালের নবেম্বরে গৃহীত অবৈধ বাণিজ্য বিষয়ক প্রটোকল অনুসরণ যেখানে লাইসেন্সিং, নজরদারি, ট্র্যাকিং এ্যান্ড ট্রেসিং, রেকর্ড কিপিং, সিকিউরিটি এ্যান্ড প্রিভেনটিভ মেজার, সেল বাই ইন্টারনেট, ফ্রি জোনস এ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যানজিট, ডিউটি ফ্রি সেলস ইত্যাদি বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া আছে।
×