ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পর কোন পথে আরব বিশ্ব? জেনে নিন

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ১৩ জুলাই ২০২৫

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পর কোন পথে আরব বিশ্ব? জেনে নিন

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পর কোন পথে আরব বিশ্ব

ইরান ও ইসরায়েলের যুদ্ধের পর থেকে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্ক কেমন তা আলোচনার বিষয়। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত শেষ হওয়ার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে শেয়ার করেন।

সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের হামলার ক্ষেত্রে উপসাগরীয় দেশগুলো দৃঢ় এবং কার্যকর অবস্থান নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ইরান ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ কাতারের সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ করেছে, যা আমাদের সকলকে প্রভাবিত করে।’’

তিনি বলেন, এই অঞ্চলে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, এখন উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে আবার আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করার দায়িত্ব মূলত ইরানের। এখন প্রশ্ন হলো, এই সংঘাত ইরানের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্কে কেমন প্রভাব ফেলেছে?

• সৌদি আরব
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত এবং আল উদাইদ ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, তারা ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। দুই দেশের মধ্যে দফায় দফায় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

বিশেষ করে গত ৮ জুলাই জেদ্দায় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সাক্ষাৎ হয়। যদিও ২০২৩ সালের মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে হওয়া চুক্তি বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে। 

সৌদি নেতৃত্ব ইরানি হজযাত্রীদের নিরাপদে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেয়। যদিও সৌদি আরব কাতারের আল উদাইদ ঘাঁটিতে ইরান হামলা চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র নিন্দা করেছিল। সেখানকার সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে গণমাধ্যম সবাই আগের মতোই স্থিতিশীলতার বার্তা দেয়।

• কাতার
কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি বলেছেন, এই হামলার ফলে ইরানের সঙ্গে কাতারের সম্পর্কের ওপর ‘নেতিবাচক’ প্রভাব পড়েছে। তবে তিনি আশা করেন, সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাতারের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক সম্পর্কের ওপর সম্ভাব্য যেকোনও ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করেন।

স্থানীয় গণমাধ্যম আল উদাইদ ঘাঁটিতে ইরানের হামলা নিয়ে বিশেষ খবর প্রকাশ করেছে, যেখানে হামলার পর কয়েকদিন ধরে পরিস্থিতি এবং কাতারের প্রতি আরব ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের খবর প্রচারিত হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ইরানে ইসরায়েলি হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।

কাতারের প্রধান সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার ওয়েবসাইটে বিশ্লেষকরা লিখেছেন, ইরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের ব্যাপারে ইসরায়েলি উদ্দেশ্য ‘উল্টো ফল’ দিতে পারে। কারণ ইরানি সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের ফলে জনগণের সহানুভূতি সরকারের প্রতি বেড়েছে, দেশ অস্থির হয়নি।

সেখানে একজন বিশ্লেষক বলেন, ইসরায়েলের প্রবল হামলা ইরানকে একতাবদ্ধ করেছে। এখন বিরোধীদের রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবি পেছনে পড়ে গেছে এবং দেশের প্রতিরক্ষার কথাই বেশি হচ্ছে।

• সংযুক্ত আরব আমিরাত
সংযুক্ত আরব আমিরাত হলো কিছু গুটি কয়েক আরব দেশের মধ্যে একটি, যাদের ইসরায়েল ও ইরান দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক আছে। এই কারণে তাদের জন্য কোনও এক পক্ষ বেছে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে এবং তারা সবার আগে শান্তি এই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে।

সরকারি পর্যায়ে, ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলা এবং সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানকে ফোন করে ‘ইরান ও তার জনগণের সঙ্গে সংহতি’ প্রকাশ করেন।

আমিরাত কোনোভাবেই ইরানে সরকার পরিবর্তনের পক্ষে কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। তারা আমেরিকার সমর্থিত ইসরায়েলি আধিপত্যকেও গুরুত্ব দেয়নি। স্পষ্টতই মনে হয় উপসাগরীয় এই দেশটি এই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি ইসরায়েল ও ইরান—দু’পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখার পথ বেছে নিয়েছে।

• কুয়েত
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই অঞ্চলে যেসব দেশে আমেরিকান ঘাঁটি আছে কুয়েত এর মধ্যে অন্যতম। এ কারণে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন ছিল। কুয়েতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

তবে অন্যান্য দেশের মতো কুয়েতও ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা করেছে। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, কুয়েত হলো ওই হাতেগোনা কয়েকটি দেশের একটি; যারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল।

অন্যদিকে, বাহরাইন ও আমিরাতের মতো অনেক দেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। গত কয়েক বছরে ইরানের সঙ্গে কুয়েতের সম্পর্ক অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের তুলনায় কিছুটা শক্তিশালী ছিল। বিশেষ করে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে চীনের মধ্যস্থতায় হওয়া চুক্তির আগ পর্যন্ত।

• ওমান
ওমান আঞ্চলিক বিষয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশটির পররাষ্ট্রনীতি আলোচনা এবং হস্তক্ষেপ না করার মাধ্যমে বিরোধ মেটানোর প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

ওমান এই বছর ইরান ও আমেরিকার মধ্যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একাধিক বৈঠকে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে। দেশটির পক্ষ থেকে এই মধ্যস্থতা শুরু হয় ২০১৩ সালে, যখন ওমান গোপন আলোচনার আয়োজন করেছিল। যা কয়েক দশকের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চ-স্তরের আলোচনা ছিল।

ইরান-ইসরায়েল ১২ দিনের সংঘাতের সময় পারমাণবিক আলোচনা স্থগিত থাকা সত্ত্বেও ওমান পর্দার আড়াল থেকে ভূমিকা পালন করেছে। অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো ওমানের স্থানীয় গণমাধ্যম মাঠের ঘটনাগুলোর কভারেজেই অগ্রাধিকার দিয়েছে।

আরব বিশ্বের সংবাদমাধ্যম প্রায়ই ওমানের আমেরিকা-ইরান মধ্যস্থতার প্রশংসা করে। অনেক সময় ওমানের এই সক্ষমতার প্রশংসা করা হয়েছে, তারা দুই পক্ষের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্বাস ও পারস্পরিক সম্মানের পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে।

• বাহরাইন
এসব হামলা এমন এক সংবেদনশীল সময়ে ঘটেছে যখন বাহরাইন ও ইরান এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের পর তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

গত ২৬ এপ্রিল বাহরাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক যত দ্রুত সম্ভব পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত কাঠামো তৈরির ওপর কাজ করছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।

তাসমিম

×