ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

সুন্দরবনের জুলেখার নিরন্তর লড়াই

এবিএম কাইয়ুম রাজ, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ১৪:৪২, ১৩ জুলাই ২০২৫

সুন্দরবনের জুলেখার নিরন্তর লড়াই

সুন্দরবনের জুলেখার নিরন্তর লড়াই

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গোলাখালী গ্রামের জুলেখা বিবির (৫২) জীবনের গল্পটা যেন এক সাহসী নারীর টিকে থাকার প্রতিচ্ছবি। স্বামী করিম গাজী সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের পেটে প্রাণ হারানোর পর থেকে নিজের কাঁধেই সংসারের ভার তুলে নেন তিনি। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৯ কিংবা ৩০। কোলের শিশু মোস্তাফাসহ চার সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় জীবন যুদ্ধ।

স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল ২০০১ সালের ২৭ মে। সে দিন করিম গাজীসহ কয়েকজন স্থানীয় জেলে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। পরদিন খবর আসে—বাঘে খেয়েছে করিমকে। একটি ক্ষতবিক্ষত দেহ ফেরে গ্রামের বাড়িতে। পরিচয় শনাক্ত করাই ছিল কঠিন। চোখের জলে সেই লাশ দাফন করেন জুলেখা।

তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী পথচলা। এক বছরের শিশুকে ঘরে রেখে মামুদো নদীতে নেমে পড়েন রেণু ধরতে। সকাল, বিকেল বা রাত নয়—ভাটা হলেই নদীতে নামেন তিনি। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা দুর্যোগ তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি কখনো। গত ২২ বছর ধরে এভাবেই নদীতে জাল টেনে চিংড়ির রেণু ধরে সংসার চালাচ্ছেন।

তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন জুলেখা বিবি। একমাত্র ছেলে মোস্তাফা কামাল এখন খুলনা বিএল কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সব সময় খুলনায় থাকতে পারেন না। পরীক্ষার তিন মাস আগে খুলনায় গিয়ে পড়াশোনা করেন, সেই খরচ জোগাতে মা ধার করেন এনজিও থেকে। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি হিসেবে ৫৫০ টাকা পরিশোধ করতে হয় তাঁকে।

জুলেখা জানান, ২০০৮-০৯ সালে ১২ হাজার টাকায় পাঁচ কাঠা জমি কিনে গোলাখালী গ্রামে একটি ঘর তুলেছেন। সেই মাটির ঘরে ছেলে মোস্তাফাকে নিয়ে তাঁর বসবাস। টিনের ছাউনি নষ্ট হয়ে গেছে, বৃষ্টি হলে ঘরে পানি পড়ে। আর নদীতে প্রতিদিনের আয় নির্ভর করে ভাগ্যের ওপর—কখনো ৫০০-৬০০ টাকা, কখনো এক টাকাও নয়।

গত কয়েক বছর ধরে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছর জুন থেকে আগস্ট—তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ, মাছ ও কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এই নিষেধাজ্ঞায় তাঁদের মতো অনেক জেলে পরিবার চরম দুর্দশায় পড়ে।

জুলেখার কথা, “স্বামীকে তো হারাইছি বাঘের পেটে, আর চাই না আমার ছেলেটাও সুন্দরবনে গিয়ে এমন হউক। চাই ও পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু করুক। সমাজের যাঁরা সাহায্য করতে পারেন, তাঁদের কাছে একটু সহযোগিতা চাই।”

স্থানীয় রমজাননগর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ বলেন, জুলেখা বিবির জীবন একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এই অঞ্চলের অনেক নারী জুলেখার মতো সংগ্রাম করে চলেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

সুন্দরবনের বুকে এমন শত শত জুলেখার গল্প প্রতিদিনই নিঃশব্দে বয়ে যায়। তবে কোনো কোনো গল্প ভেসে ওঠে—জুলেখার মতো একজন সাহসী মায়ের জীবনভিত্তিক সংগ্রামে।

তাসমিম

×