ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৭ আগস্ট ২০২৫, ২৩ শ্রাবণ ১৪৩২

বাঙালির পাতে আবার ফিরছে মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ

সঞ্জয় সরকার

প্রকাশিত: ০০:৫০, ১ আগস্ট ২০২৪

বাঙালির পাতে আবার ফিরছে মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ

সোমেশ^রীতে এক সময় প্রচুর পরিমাণে মহাশোল পাওয়া যেত। এখন কালেভদ্রে দেখা মেলে

মাছের রাজা যেমন ইলিশ, তেমনি মাছের রানী বলা হয় মহাশোলকে। ঐতিহ্যবাহী মহাশোল মাছের নাম শুনেননিÑ এমন একজন বাঙালিও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মিঠা পানির সবচেয়ে সুস্বাদু এ মাছটির স্বাদ গ্রহণের সৌভাগ্য হয়নি অনেকেরই। কারণ মহাশোল এখন মহাবিপন্ন প্রজাতির মাছ। সচরাচর এর দেখা মেলে না।

কালেভদ্রে দু-একটি পাওয়া যায়। বাজারে উঠলেও দাম হাঁকা হয় আকাশচুম্বী। ফলে সকলের পক্ষে তা কেনা সম্ভব হয় না। তবে আশার কথা হচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী মহাশোল মাছ আবার বাঙালির পাতে ফেরার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে সরকারি উদ্যোগে মহাশোলের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন এবং বিতরণ শুরু করা হয়েছে। উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে মাছ চাষিদের। এ কারণে পুকুরেও এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এর চাষ শুরু হয়েছে।
মহাশোল মাছ কোথায়ও কোথায়ও মহাশের, মাশুল, টর, চন্দনা প্রভৃতি নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিন ধরনের মহাশোল মাছের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রধান দুটি প্রজাতির নাম র্টপুটিটরা (লাল-পাখনা মহাশোল) ও র্টটর (সোনালি মহাশোল)। এক সময় নেত্রকোনার পাহাড়ি নদী সোমেশ^রী আর কংস ছিল এই দুই প্রজাতির প্রধান এবং স্থায়ী ঠিকানা। সোমেশ^রীতে এক সময় প্রচুর পরিমাণে মহাশোল পাওয়া যেত। এখন কালেভদ্রে দু-একটির দেখা মেলে।

সোমেশ^রীর ওই দুটি প্রজাতির বাইরে বছর চারেক আগে বান্দরবানের সাঙ্গু নদীতে ‘র্টবারাকা’ নামে আরও একটি প্রজাতির সন্ধান আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এটি নিয়ে বাংলাদেশে আজ তিন প্রজাতির মহাশোলের অস্তিত্ব সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত। উল্লিখিত তিনটি নদীর বাইরে কাপ্তাই হ্রদ এবং সুনামগঞ্জের দু-একটি পাহাড়ি নদীতেও মাঝেমধ্যে দু-একটা মহাশোল মাছের দেখা মিলত। তবে এখন আর সেখানে পাওয়া যায় না। হাওর-বিলেও কখনো এর দেখা মিলেছে বলে শোনা যায় না। 
মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, পাহাড়ি নদীর পাথর ও নুড়ির ফাঁকে ‘পেরিফাইটন’ নামক এক প্রকার শ্যাওলা জন্মে। এসব শ্যাওলাই মহাশোলের প্রধান খাদ্য। দ্রুত আবহাওয়ার পরিবর্তন, নদীগুলোর স্বাভাবিক অবস্থা ধ্বংস, বাঁধ নির্মাণ, শুকনো মৌসুমে তলদেশ শুকিয়ে যাওয়া, বালুর চর জাগা, ড্রেজার ও বোমা মেশিনে বালু-পাথর উত্তোলন প্রভৃতি নানা কারণে মহাশোল মাছের বিচরণ এবং প্রজননের পরিবেশ আজ বিপন্ন। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-২ অনুযায়ী মহাশোল মাছও সংরক্ষিত। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ঘোষিত মহাবিপন্ন মাছে তালিকায় অনেক আগেই স্থান করে নিয়েছে ঐতিহ্যবাহী মহাশোল।
মহাশোল মাছ দেখতে অনেকটা মৃগেল মাছের মতো। তবে আঁশ বড়। র্টপুটিটরা (লাল-পাখনা মহাশোল) প্রজাতির মাছের শরীর সুগঠিত এবং বেশ গভীর। মাথা তুলনামূলকভাবে ছোট। চোখ মাথার অঙ্কিয় তল থেকে দেখা যায়। পিঠ ধনুকের মত বাঁকা। মুখ ছোট। মুখের চির চোখের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত নয়। ঠোঁট পুরু ও মাংসল। পিঠের অংশ ধূসর-সবুজ, পার্শ্বদিক হালকা গোলাপী যার ওপরের দিকে সবুজাভ সোনালি, কিন্তু নিচে হালকা জলপাই-সবুজ বর্ণের হয়।

এদের পেটের রং রুপালি, মাথা ফুলকা রন্ধ্রের ওপরে হালকা গোলাপী বর্ণের এবং চোখের নিচে হালকা হলুদ ও কানকোতে হালকা আকাশী নীল বর্ণের হয়। পিঠের পাখনা লালচে। শ্রোণী বক্ষ এবং পায়ু-পাখনা দেখতে গাঢ় কমলা বর্ণের। এদিকে র্টটর (সোনালি মহাশোল) প্রজাতির অপরিণত মহাশোল মাছের পিঠও ধনুকের মত বাঁকা থাকে। তবে পরিণত মাছের পিঠ এবং অঙ্কিয় দেশ প্রায় সোজা। মুখ ছোট, চিরটি সম্মুখ কিনারার নিচ পর্যন্ত প্রসারিত নয়, উপরের চোয়াল সামান্য দীর্ঘ।

ঠোঁট পুরু ও মাংসল, নিচের ঠোঁটে একটি পশ্চাৎ খাঁজ বিদ্যমান। পিঠের অংশ সবুজাভ রূপালি বর্ণের কিন্তু পার্শ্বদিক থেকে রুপালি বর্ণের সঙ্গে সোনালি প্রতিফলন দৃশ্যমান। সোনালি বর্ণের আঁশগুলোর গোড়ার দিকে ক্ষুদ্রক্ষুদ্র কালো বিন্দু যুক্ত হয়ে ধূসর বর্ণ ধারণ করে। পাখনাগুলো হলুদাভ। এ ছাড়া সাঙ্গু নদী থেকে পাওয়া ‘টর বারাকা’ প্রজাতিটি নিয়ে মৎস্যবিজ্ঞানীদের গবেষণাকর্ম এখনও চলমান।

এ কারণে এটির আকৃতির বিস্তারিত বিবরণ এখনো প্রকাশ হয়নি। মহাশোল মাছ সর্বোচ্চ ১৫ মিটার পর্যন্ত গভীর পানিতে চলাচল করতে পারে। ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পানির তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এদের ডিম পরিমাণ তুলনামূলক কম। 
সোমেশ^রীর মহাশোল মাছের স্বাদ এখনো প্রবীণদের মুখেমুখে ফিরে। দুর্গাপুরের কয়েক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, তারা অতীতে ২৫-৩০ কেজি ওজনের মহশোলও দেখেছেন। অতীতে নেত্রকোনার বিভিন্ন হাটেবাজারে ঢোল পিটিয়ে বা মাইকিং করেও মহাশোল মাছ বিক্রি হয়েছে। তবে এখন আর এত বড় মহাশোলের দেখা  মেলে না। কালেভদ্রে নেত্রকোনা শহরের মাছ বাজারে দু-চার কেজি ওজনের দু-একটা মহাশোল উঠতে দেখা যায়। তবে তা বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যায়। অনেক সময় তা উপঢৌকন হিসেবে চলে যায় ভিভিআইপিদের হেঁসেলে।

২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে কলমাকান্দা উপজেলার তেগুরিয়া বাজারে ১৭ কেজি ওজনের একটি মহাশোল উঠেছিলÑ যা ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। গত ১০ বছরে ধরা পড়া মহাশোলের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে বড়। রায়পুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের এক জেলের জালে ধরা পড়েছিল মাছটি। এ ছাড়া ২০২১ সালে দুর্গাপুর শহরের মাছবাজারে ২১ হাজার টাকায় বিক্রি হয় সাত কেজি ওজনের আরেকটি মাছ। মাঝেমধ্যে নেত্রকোনা শহরের মেছুয়া বাজারেও দু-একটা মহাশোল মাছ ওঠে। তবে এগুলোর বেশিরভাগই চাষ করা।  
জানা গেছে, সোমেশ^রী নদীর মহাশোল মাছ নিয়ে অনেক গান, কবিতা, এমনকি টিভি নাটক পর্যন্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষের ধারণা, মহাশোল একটি ঔষধি গুণসম্পন্ন মাছ। এজন্য জটিল রোগবালাই থেকে মুক্তি পেতেও মহাশোল মাছের সন্ধান করতেন অনেকে। দুর্গাপুরে এক সময় কন্যার বিয়ের পর নতুন জামাইয়ের পাতে মহাশোল মাছ পরিবেশন করা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।

শহর থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ কোনো মেহমানকেও মহাশোল মাছ ছাড়া আপ্যায়ন করার ব্যাপারটিও ছিল ঐতিহ্যগতভাবে বেমানান। মহাশোল মাছ অনেকে চেনেন না। ফলে এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে বাজারে প্রতারণাও চলছে। বড় আকারের মৃগেল, গ্রাসকার্প এবং ব্ল্যাক কার্প মাছকে মহাশোল বলে চালিয়ে দিচ্ছেন কিছু অসাধু বিক্রেতা। না চেনার কারণে বিক্রেতাদের কথায় প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে।
মহাশোল মাছ নিয়ে আশা বাণী শুনিয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন ময়মনসিংহ স্বাদুপানি কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মশিউর রহমান জানান, প্রতিষ্ঠানটি ৭-৮ বছল ধরে ‘বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছের প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে মহাশোলের পোনা উৎপাদন কৌশল এবং পুকুরে চাষাবাদের পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাশাপাশি টরপুটিটরা প্রজাতির মহাশোল মাছের পোনা উৎপাদন করে চাষীদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। চাষি ও হ্যাচারির মালিকদের উব্দুদ্ধ করতে দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা। এ ছাড়া র্টটর জাতের মহাশোল মাছের প্রজননের চেষ্টা চলছে। শীঘ্রই এটিরও পোনা উৎপাদন সম্ভব হবে। আর টরবারাকা জাতের মহাশোল নিয়ে গবেষণা চলছে।
ড. মশিউর রহমান আরও জানান, বর্তমানে ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রে মা মাছ হিসেবে র্টপুটিটরা জাতের অন্তত ৫শ’ এবং টরটর জাতের ৩০-৩৫টি মা মাছ সংরক্ষিত আছে। এগুলো সোমেশ^রী নদী থেকে সংগ্রহ করা। এই মাছগুলোকে ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক খাবারে অভ্যস্ত করা হয়েছে। গত এক বছরে অন্তত ৫০ হাজার পোনা বিতরণ করা হয়েছে আগ্রহী চাষিদের মাঝে। বিপন্ন প্রজাতির মহাশোল মাছকে বিকল্প পদ্ধতিতে আবারও বাঙালির পাতে ফিরিয়ে আনাই ছিল প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য।

উদ্দেশ্য অর্জনে প্রকল্পটি এখন অনেকটাই সার্থক। এখন অনেকে মাছটি চাষ করছেন। স্থানীয় বাজারে প্রায়ই চাষ করা মহাশোল মাছ পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতারাও আনন্দের সঙ্গে লুফে নিচ্ছেন। তবে নদীর মহাশোলের চেয়ে চাষ করা মহাশোলের স্বাদের কিছুটা তারতম্য আছে বলে স্বীকার করেন এ কর্মকর্তা। 
মৎস্য গবেষণা ইনিস্টটিউটের কর্মকর্তা ও চাষিদের কথায় এটি প্রতীয়মান হয় যে, ঐতিহ্যবাহী মহাশোল মাছ আর হারিয়ে যাবে না। স্বাদে যেমনই হোক, খুব শীঘ্রই তা সহজপ্রাপ্য হবে।

×