ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

খান আব্দুল গাফফার খান আজও বাঙালির হৃদয়ে

একাত্তরে বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যে পশতুন নেতা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২১ মে ২০২৪; আপডেট: ০১:৫৮, ২২ মে ২০২৪

একাত্তরে বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যে পশতুন নেতা

একই মঞ্চে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে (মাঝখানে) বাংলাদেশের সুহৃদ সীমান্ত গান্ধীখ্যাত খান আবদুল গাফফার খান

বাঙালির ঘোর অমানিশার কাল ছিল একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের প্রতি প্রান্তে গণহত্যা চালিয়েছে। অগণিত ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। তবে বিশ্ববিবেক ছিল বাঙালির পক্ষেই। বহু দেশের মানবিক মানুষ, নাগরিক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।

একাত্তরের এই বন্ধু সুহৃদদের অন্যতম খান আব্দুল গাফফার খান। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এবং আফগানিস্তানে বসবাসরত পশতুন সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন তিনি। 
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, পশতুনরা শুরু থেকেই ব্রিটিশ শাসনের ঘোরবিরোধী ছিল। খান আব্দুল গাফফার খানও ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। ইসলাম ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী খান চেতনার দিক থেকে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। স্বপ্ন দেখেছেন ধর্মনিরপেক্ষ অখ- ভারতের। এই লক্ষ্যে ১৯২০-এর দশকে খুদাই খিদমতগার নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার এই সংগঠন ব্যাপক সক্রিয় ছিল।

খান আব্দুল গাফফার খান ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর বেশ ঘনিষ্ঠ। সীমান্ত অঞ্চলে আন্দোলন সংগঠিত করার সময় গান্ধীর অহিংস নীতি অনুসরণ করেন তিনি। এ কারণে তাকে সীমান্ত গান্ধী নামে ডাকা হতো। পরিচিত ছিলেন বাদশা খান নামেও। ভারত ভাগের প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানে স্থায়ী হন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। পরবর্তীতে চলে যান আফগানিস্তানে। ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সময় আফগানিস্তানেই ছিলেন তিনি। সেখান থেকেই বাঙালির পক্ষে কাজ শুরু করেন। 
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সুহৃদদের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার কবির। পাকিস্তানে গিয়ে তাদের অনেকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন তিনি। বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছেন। তথ্য সংগ্রহ করেছেন খান আব্দুল গাফফার খানের ভূমিকা সম্পর্কেও। কী ছিল এই সুহৃদের ভূমিকা? কোন চিন্তা থেকে বাংলাদেশের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন?

জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে বিশিষ্ট এই লেখক সাংবাদিক বলেন, খান আব্দুল গাফফার খান ছিলেন  সেকুলার ন্যাশনালিস্ট। ফলে ১৯৪৭ সালে জিন্নাহকে তিনি সমর্থন করেননি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ধর্মীয় রাজনীতিনির্ভর মুসলিম লীগও তার সমর্থন পায়নি। এসব কারণে অনেক বছর গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল তাকে। পূর্ব পাকিস্তানে যে অন্যায় হচ্ছিল সে বিষয়েও তিনি অবগত ছিলেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কাবুল থেকে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ শুরু করেন তিনি।             
শাহরিয়ার কবির বলেন, সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে বহু বাঙালি আটকা পড়েন। বিশেষ করে সেনা কর্মকর্তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। এই সেনা কর্মকর্তাদের পাক-আফগান সীমান্ত দিয়ে বের হয়ে আসতে সহায়তা করেন তিনি। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানকে সংযুক্ত করেছে খাইবার গিরিপথ। গিরিপথ বস্তুত পশতুনদের অধিকারে ছিল।

ফলে তাদের জন্য বাঙালিকে সহায়তা করা সম্ভব হয়েছিল। অনেক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা পার্বত্য গিরিপথে ভারত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানান শাহরিয়ার কবির।    
তবে বাংলাদেশের পক্ষে আব্দুল গাফফার খানের অবস্থান গোটা দুনিয়ার কাছে পরিষ্কার হয় ১৯৭১ সালের ২২ মে, মানে, আজকের দিনে। ওই দিন কাবুল থেকে একটি বিবৃতি পাঠান তিনি। পত্রপত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হওয়া সেই বিবৃতিতে পাকিস্তানের কঠোর সমালোচনা করেন খান।

সেইসঙ্গে বাঙালির অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তোলেন। সে সময়ের পত্রপত্রিকায় তার যে বিবৃতি ছাপা হয়, সেটি এখনো কোনো কোনো অনলাইন আর্কাইভে পাওয়া যায়। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, সীমান্ত গান্ধী পরিস্থিতি বুঝে পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক শাসকের গোঁয়ার্তুমির কারণে তা সফল হয়নি।

বিবৃতিতে এসব বিষয় তুলে ধরে খান আব্দুল গাফফার খান বলেন, পাকিস্তান সরকারকে আমি জানিয়েছিলাম, তারা দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে চাইলে শেখ মুজিব ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়া করার জন্য মধ্যস্থতা করতে আমি রাজি আছি। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা এ প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। 
তিনি সুস্পষ্ট করে বলেন, পাকিস্তান ধ্বংস হলে তা হবে ভুট্টো ও কাইয়ুম খানের ভুল নীতির জন্য। 
তার মতে, পূর্ব পাকিস্তানের অপরাধ হলো, তারা নির্বাচনে জয় লাভ করেছে। ৬ দফা যদি পাকিস্তানের সংহতির জন্য বিপজ্জনকই হয়, তাহলে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কেন গোড়াতেই এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলো না? জানতে চান তিনি। বলেন, বাঙালিরা প্রকৃত মুসলমান। তাদের প্রচেষ্টাতেই পাকিস্তান হয়েছে। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেন দেশ ভাঙতে চাইবে?
পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাকিস্তান সব সময়ই ধর্মের নামে হঠকারিতা করেছে। অযথা বলপ্রয়োগ করে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অপপ্রচার বন্ধ করতে পাঞ্জাবের পুঁজিপতি ও সমর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করার কথাও জানান তিনি। শাহরিয়ার কবিরের মতে, খান গাফফার খানের এই বিবৃতি সে সময় বাঙালির ন্যায় যুদ্ধকেই সমর্থন করেছিল। 
এদিকে, সীমান্ত গান্ধীই নন শুধু, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তার সন্তান পাকিস্তানের আরেক আলোচিত রাজনীতিক খান আব্দুল ওয়ালী খানও। শাহরিয়ার কবিরের তথ্য মতে, আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির সভাপতি ওয়ালী খান বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের ছিলেন। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন শেখ মুজিব।

এর পর থেকে দেশে অসযোগ শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থায়ও ২৩ মার্চ ঢাকায় এসে মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করায় পাকিস্তানে তার দল নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আরও নানাভাবে হেনস্তা করা হয় তাকে। 
স্বাধীন বাংলাদেশ একাত্তরের সকল বিদেশী সুহৃদদের প্রতি কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতার কথা তাদের অনেককে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে খান আব্দুল গাফফার খান এবং ওয়ালী খানকেও সম্মাননা জানানো হয়। তাদের পরিবারের সদস্য ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন।

×