বগুড়ার সোনাতলায় নাজির আখতার কলেজ ক্যাম্পাসে পারুল গাছে ফুল ফুটেছে। বিরল এই পারুল গাছের চারা তৈরিতে সফল হয়েছেন মো. সজল (বাঁয়ে)
পারুলের নাম শোনেননি এমন সংখ্যা হয়তো খুবই কম। পারুলের দেখা পেয়েছেন এমন সংখ্যাও নাম শোনার বিপরীত চিত্রের মতো। পারুল নিয়ে গান-কবিতাসহ সাহিত্যের নানা শাখায় উচ্চারিত হয়েছে এর নাম। আর সাত ভাই চম্পার বোন পারুলের আকুলতা তো শুধু গানে নয় হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। পারুল নিয়ে এত গান কবিতা গল্প ছড়িয়ে থাকলেও পারুলের দেখা পাওয়া তো সৌভাগ্য হিসেবেই ধরে নিতে হয়। আর কোথায় পারুল তা নিয়ে প্রকৃতি ও বৃক্ষপ্রেমীদের গবেষণাও কম হয়নি। তাই পারুল রহস্যের অবগুণ্ঠনে থাকা এক ফুলই নয় বিরল বৃক্ষও। এমন বিরল প্রজাতির পারুল মুগ্ধতার আবির ছড়িয়ে অপার সৌন্দর্যে আবেশ ছড়াচ্ছে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার এক শিক্ষাঙ্গনে। প্রায় শতবর্ষী এই পারুল গাছ শুধু বৃক্ষ ও প্রকৃতিপ্রেমী নয় উদ্ভিদ গবেষকদের নজরেও রয়েছে। প্রকৃতির চাদরের অবগুণ্ঠন সরিয়ে আলো ছায়ায় পারুল এখন ফুলে ফুলে সেজেছে। এক অপরূপ মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে ঝড়া ফুলে পারুল তলা মোহনীয় আকর্ষণ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
পারুল নিয়ে কবি গুরুর গানে উঠে এসেছে ‘আজ পারুল- দিদির বনে মোরা চলব নিয়ন্ত্রণে, আজ চাঁপা-ভায়ের শাখা ছায়ের তলে মোরা সবাই জুটেছি। কবির গানে ‘পারুলের হিল্লোল’র কথাও উঠে এসেছে। তবে কবি গুরু পারুল বনের কথা বললেও পারুল এখন অচেনা ও নিজভুমে পরবাসী হিসেবে অপরিচিত অতিথির মতো। নতুন প্রজন্মের কাছে পারুল ফুলও তাই প্রকৃতির অচেনা। নাম শুনলেও এর দেখা মেলা ভার। লেখক প্রকৃতিপ্রেমী ওয়াহেদুল হক ’৭০-এর দশকে অথঃপুষ্প শিরোনামে লেখনীতে পারুলের কথা তুলে ধরলে দেশে পারুল আছে কি না তা নিয়ে আলোড়ন উঠেছিল। উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ ও প্রকৃতিপ্রেমীরা এ নিয়ে পরে বিস্তর অনুসন্ধান চালান। প্রকৃতিপ্রেমী এক উদ্ভিদ বিশারদ এক লেখায় বলেই ফেলেছিলেন ‘বঙ্গে পারুল নেই’। দেশের কয়েকটি স্থানে পারুল থাকার বিষয়টি উঠে আসলেও এ নিয়ে তেমন বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় নাজির আখতার কলেজ প্রাঙ্গণে থাকা পারুল গাছটিই বিরল পারুল গাছ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের উদ্ভিদ শ্রেণি বিন্যাস তত্ত্ববিদ (ট্যাক্সনমি) প্রফেসর ড. এএইচএম মাহবুবুবর রহমান এটিকে বিরল জাতের বৃক্ষ পারুল হিসেবে জানিয়ে বলেন, এটি লতা পারুল নয়। আর বৃক্ষ পারুলই মূল প্রজাতির পারুল হিসেবে উল্লেখ করেন। আর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শ্রেণি বিন্যাস তত্ত্ববিদ (প্লান্ট ট্যাক্সনিমিস্ট)প্রফেসর ড. মোহাম্মাদ জসিম উদিন জানিয়েছেন, বগুড়ার সোনাতলার গাছটি পারুল এ নিয়ে সন্দেহ নেই। এটি অনেক আগেই একটি মীমাংসিত বিষয়। তবে আরো কয়েকটি পারুল গাছ দেশের পার্বত্য এলাকার বনাঞ্চলে রয়েছে।
পারুল একেবারে হারিয়ে যায়নি। তবে তা আমাদের লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় তেমন সামনে আসেনি বলে জানান। অরেক গবেষক জানান, বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের ট্রেনিং স্কুল চত্বরে পারুল গাছ ছিল। তবে পারুল নিয়ে অনেক কথা থাকলেও উদ্ভিদ গবেষক ও প্রকৃতিপ্রেমীরা পারুল গাছ দেখতে সোনাতলায় আসেন। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনিটিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর অপূর্ব রায় এই পারুলকে বিরুল জাতের হিসেবে উল্লেখ করে জানান কয়েক বছর আগে তিনি এটির টিস্যু কালাচারের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে সেটি আর এগোয়নি।
সোনাতলায় স্থানীয় ভাবে পারুল গাছটির নাম দেওয়া হয়েছে চম্পা পারুল। পারুলের আদি নাম পাটল। পাটল একটি রঙের নাম। পাটল থেকে পাড়ল পারউল নামে পরিবর্তিত হয়েছে বলে বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। পারুলজাতা আটকাপালি বিভিন্ন নাম রয়েছে পারুলের। বগুড়ার সোনাতলায় যেখানে বিরল পারুল গাছটি রয়েছে, সেটি কলেজের মূল ভবনের সামনের প্রাঙ্গণ। নাজির আখতার কলেজের জমিদাতা সৈয়দ নুরুল হুদার পিতা ও মায়ের নামে কলেজটির নামকরণ। সৈয়দ নুরুল হুদা কর্মস্থল সূত্রে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন। মেদিনীপুরের থরগপুর থেকে একটি দুটি পারুল গাছ নিয়ে এসেছিলেন। তিনি গাছ দুটি তার বসতভিটায় লাগিয়েছিলেন। এর একটি মরে গেলেও এখনকার পারুল গাছটি তার একটি। নুরুল হুদা পরবর্তীতে জমি কলেজে দান করলেও গাছটিও কলেজের ঐতিহ্য হয়ে যায়। পারুলের আরেক নাম অমোঘা। পারুলকে বসন্তি দ্যুতিও বলা হয়। কারণ শীত শেষে পারুল নব যৌবন আসে। অলিপ্রিয়াও পারুলের আরেক নাম। তবে ঘট পারুল নামে এক ধরনের ফুল আছে তাকেও অনেকে পারুল বলে ডাকেন।
পারুলকে আবার কৃষ্ণবৃন্তাও বলা হয়। সোনাতলার পারুল গাছটি ৫০ থেকে ৬০ ফুট লম্বা। সাধারণত মে মাসে শেষের দিকে ও এপিল থেকে নতুন পাতা আসতে থাকে। এপিলের প্রথম দিক থেকেই পারুলের ফুল দেখা যায়। পর্যায়ক্রমে এর ফুল ও পাতা আসে। ঝড়া ফুলে ছেয়ে যায় পারুল তলা। সাদা প্রায় ১ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে এই ফুলের নিচের অংশে হাল্কা গোলাপি রঙের আভা ও ভিতরে হলুদাভ ছোপ দেখা যায় ঝরা ফুলে। ফুলের সৌরভ হাল্কা ধরনের। পারুলের ফল বাঁকানো ধনুকের মতো চিকন। দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ ইঞ্চি। ভেতরে বীজ রয়েছে। গাছের রং ধূসর-কালচে। এর বেধও কমপক্ষে ১৮ থেকে ২০ ফুট।
বিরল প্রজাতির পারুল গাছটি শত বর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ায় এবং এর বংশবৃদ্ধি না হওয়ায় এটি আবার হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিযেছিলো। তবে এলাকার গড় ফেতেহপুর এলাকার চারা নিয়ে কাজ করা সদানন্দ সজল সে আশঙ্কা দূরে ঠেলে দিয়েছেন। পারুলের টিস্যু কালচারে বংশবৃদ্ধি আশার কথা না শোনালেও সজল কিন্তু ঠিকই প্রথমে বীজ থেকে চারা আবার পর চারার শিকর থেকে চারার বংশ তৈরি করেছেন। তিনি জানালেন তার নার্সারিতে ৮/১০টি পারুল চারা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিক্রিও করেছেন। সরকারি নাজির আখতার কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আলী আশরাফ জানান পারুল গাছটি তাদের কলেজের গর্ব। প্রায়ই দর্শনার্থীরা পারুলতলায় ভিড় জমান। ছবি তোলেন ও কলেজের ইতিহাস জানতে চান, সঙ্গে জানতে চান পারুল গাছটি কিভাবে এলো। পারুলপ্রেমী স্থানীয় লেখক ও সাংবাদিক ইকবাল কবির লেমন জানান, এটি বিরল জাতের পারুল। এমন বৃহৎ অবয়বের পারুল গাছ আর কোথাও আছে কি না সেটি তাদের জানা নেই।
পারুলের প্রজাতি ও এ নিয়ে নানা কথা থাকলেও নিসর্গ ও প্রকৃতিপ্রেমীর মানুষদের কাছে সোনাতলা বৃহৎকায় বিরল জাতের পারুল গাছের আবেদন ও আকর্ষণ বছরের পর বছর ধরে। পারুল শুধু একটি ফুলগাছ নয় প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধনের অপর নাম। বিশালকায় গাছটি শুধু ফুল দিয়েই নয় এর প্রাচীনত্ব আর মমত্ব নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলেছে। এক মোহময় আকর্ষণ তৈরি করেছে। যার টানে প্রকৃতিপ্রেমী থেকে সাধারণ দর্শনার্থী ছুটে যান এর সান্নিধ্যের জন্য।