
.
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি জুড়ে মেলা চলল। তার পর বাড়তি আরও দুই দিন। শেষ দুটি দিন ধার করা হলো মার্চ থেকে। সব মিলিয়ে ৩১ দিনের আয়োজন এবং অতঃপর আজ শনিবার ‘বিদায়’ বলার পালা, সমাপনী দিন। বহু আবেগ-ভালোবাসার বইমেলা আজ সাঙ্গ হচ্ছে।
এবারের মেলায় পুরনো অসুখের পাশাপাশি নতুন কিছু রোগ-বালাইয়েরও দেখা মিলেছে। অপাঠক অলেখক অপ্রকাশকরা, বলা চলে, নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল মেলার। কোনো কোনো প্রকাশক স্রেফ দোকানদারিটাই করেছেন।
তাদের চোখ ছিল ফেসবুকে। ইউটিউবে। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমগুলোতে কাদের নিয়ে মাতামতি হচ্ছে, আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে তারা সেগুলো খেয়াল করেছেন। ‘ভাইরাল’ ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের বই প্রকাশ করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বই বই না। লেখকও লেখক না। আর প্রকাশকরা আসলে প্রকাশনা শিল্পের কলঙ্ক। প্রকৃত প্রকাশকরা এই আগাছাদের জন্য দিনের পর দিন বিব্রত হয়েছেন। অপাঠকদের দেখা গেছে মেলা ঘুরে শুধু ছবিই তুলছেন। বই হাতে নিয়ে শরীর তিন বাঁকা করে ছবি তুলে দিব্যি চলে গেছেন। বইটি কেনার কথা ভাবেননি! স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের উচ্ছৃঙ্খল যে অংশ, সেটিও বেশ ভুগিয়েছে। তারা মেলায় এসে পঙ্গপালের মতো ছুটে বেড়িয়েছে। হৈ হুল্লোড় করেছে। উগ্রবাদী আচরণও দেখা গেছে। মেলা থেকে যাকে পছন্দ না তাকে অপদস্থ করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি ছিল দর্শকের ভূমিকায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার। তবে আশার কথা যে, শেষ পর্যায়ে বইয়ের মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দেদার বই বিক্রি হচ্ছে মেলায়।
অমর একুশে বইমেলার ৩০ দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে মনে হয়েছে, বই সংগ্রহের ধুম পড়েছে। পছন্দের বইয়ের তালিকা হাতে কত মানুষ যে ছুটছিলেন! অধিকাংশ বইয়ের স্টলেই ক্রেতারা ভিড় করেছিলেন। নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায়নি। মাথার ওপর দিয়েও অনেককে বই সংগ্রহ করতে বা টাকা পরিশোধ করতে দেখা গেছে।
বেলা ১১টায় শুরু হওয়া মেলা শেষ হয়েছে রাত ৯টায়। বের হওয়ার সময় অধিকাংশের হাতে ছিল বই। বই তো নয়, বইয়ের ব্যাগ। কারও কারও বই বহন করতে কষ্ট হচ্ছিল। তার পরও চোখেমুখে আনন্দ দেখা গেছে।
কিন্তু বই যারা কেনেন না তারা তো কেনেন-ই না। যারা কেনেন তারা সবাই কি পড়েন? কতটা পড়া হয়? এই প্রশ্নটিও সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়ে সামনে আসতে শুরু করেছে। মেলা থেকে বই কিনে ফেরার পথে অন্তত ১০-১২ জনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাদের কেউ কেউ একসময় বই পড়তেন। এখনো বই ভালোবাসেন। পড়তে চান। সময় করে পড়বেন- এমন চিন্তা থেকে বই কিনেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, গত বছরও প্রচুর বই কিনেছেন। সেই সব বই ক’দিন চোখের সামনে রেখেছেন। পাতা উল্টিয়ে দেখেছেন পছন্দের বই। কিন্তু শেষতক আর পড়া হয়নি। পড়তে পড়তে নাকি এবারের মেলা চলে এসেছে! সময় না থাকা, অভ্যাস নষ্ট হয়ে যাওয়াসহ বেশকিছু কারণও উল্লেখ করেছেন বই কিনে বাড়ি ফেরা মানুষেরা। বিচিত্র বইপ্রেমের গল্প এবং না পড়তে পারার আক্ষেপ দুটোই খুঁজে পাওয়া গেছে তাদের কথায়।
২১৯ নতুন বই ॥ ৩০তম দিনে মেলায় নতুন বই এসেছে ২১৯টি। বিভিন্ন দিনে মেলায় আসা বইগুলোর মধ্যে মাওলা ব্রাদার্স থেকে এসেছে মহাদেব সাহার কাব্যগ্রন্থ ‘লাজুক পদ্ম।’ আগামী থেকে এসেছে হাসনাত আবদুল হাইয়ের গল্পের বই ‘তোমার ঘরে বসত করে ক’জনা’। জার্নিম্যান প্রকাশ করেছে তিন আরব কবির কবিতার অনুবাদ ‘মানচিত্রের বলি’। ভাষান্তর করেছেন সাদিকুর রহমান পরাগ। ‘মওদুদী-জামায়ত ফেৎনার স্বরূপ’ প্রকাশ করেছে হাওলাদার প্রকাশনী। সংকলন সম্পাদনা করেছেন আনোয়ার কবির।
স্মৃতিপটে বাংলাদেশ গ্রন্থের প্রকাশনা ॥ মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিলের সংকলন ‘স্মৃতিপটে বাংলাদেশ’ মেলায় এনেছে জার্নিম্যান বুকস। শুক্রবার সিরিজ গ্রন্থের প্রথম খ-ের আনুষ্ঠানিক পাঠ উন্মোচন করা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের লেখক গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ব্রিটেনের প্রধান নয়টি পত্রিকার প্রায় সকল প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও ছবি থাকছে দুর্লভ গ্রন্থ সিরিজে। ১২০০ পৃষ্ঠার অধিক এই অমূল্য সংগ্রহটি যুদ্ধদিনে পরম যতেœর সঙ্গে গ্রন্থনা করেছেন সে সময়ে লন্ডনে এফসিএ অধ্যয়নরত বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র শাহাবুদ্দিন চৌধুরী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশপ্রেমিক এই বাঙালি যুবক মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। ৫২ বছর পর এগুলো বই আকারে প্রকাশের কাজ শুরু হয়েছে।
আবেগঘন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর সহধমিণী মর্জিনা চৌধুরী, যিনি এই বিপুল তথ্য-ভান্ডার পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন। উপস্থিত ছিলেন কন্যা রেশমীন চৌধুরী। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জার্নিম্যানের পক্ষে এর কর্ণধার কবি তারিক সুজাত উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
বক্তারা বলেন, এই গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণায় বিশেষ সহায়তা করবে। একে একে বাকি খন্ডগুলোও প্রকাশ করা হবে বলে জানান প্রকাশক।