
১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে শহীদ শিশু পুত্রের ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ (বামে), সেরনিয়াবাত পরিবারের শহীদ হওয়া ছয়জন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ভয়াল সেই কালরাতে ঢাকার ২৭ মিন্টো রোডের বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মায়ের কোলের মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান দেড় বছরের শিশু! তার পরের ইতিহাস ভিন্ন। সেদিনের সেই শিশুটি আজকের বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ।
সাদিক বঙ্গবন্ধুর বোন জামাতা শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠপুত্র মন্ত্রী পদমর্যাদার পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির সভাপতি এবং বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির জ্যেষ্ঠ পুত্র।
সেদিনের সেই কালরাত্রি সম্পর্কে বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি গোষ্ঠী পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু দেশের জনগণ তা হতে দেয়নি। শহীদ জননী মায়ের মুখে শোনা সেইদিনের দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত ও অশ্রুসজল নয়নে মেয়র আরও বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কালরাতে আমার দাদা (বঙ্গবন্ধুর বোন জামাতা) আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, আমার বড় ভাই সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেদিন ঢাকার মিন্টো রোডের বাসায় আমি মায়ের কোলে ছিলাম। আমার মা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহানারা বেগমও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। জীবন বাঁচাতে আমরা ভারতে হিন্দু পরিচয়ে ছিলাম। যাতে কারও সন্দেহ না হয়। সে সময় আমাদের পেলেও মেরে ফেলা হতো। মেয়র আরও বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে পরবর্তীতে দেশ ও জনগণের টানে আমরা দেশে ফিরে এসেছি। জীবনে যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন জনগণের সেবা করে যেতে চাই।
আজও তাড়া করে স্বজন হারানোর বেদনা ॥ ভয়াল ও আতঙ্কের কালরাত্রির রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের পাশাপাশি হামলা চালিয়েছিল সেরনিয়াবাত পরিবারের ওপর। ওইদিন ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন মন্ত্রী (বঙ্গবন্ধুর বোন জামাতা) আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭ মিন্টো রোডের বাসভবনে হামলা চালানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা গেছে, হামলাকারীরা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাসভবন খুব দ্রুতগতিতে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলির শব্দে ঘুম ভাঙলে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তার বাড়ির রেডফোন দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ মনিকে বিষয়টি অবহিত করে জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুর ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়ির চারদিকেও একই অবস্থা। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘাতক সেনারা দরজা ভেঙ্গে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার স্ত্রী (বঙ্গবন্ধুর বোন) আমিনা বেগম, মেয়ে বেবী ও বিউটি সেরনিয়াবাত, ছেলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, ভাইয়ের ছেলে শহিদ সেরনিয়াবাত, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর স্ত্রী সাহান আরা বেগম ও তার সন্তানসহ বরিশালের অনেককেই অস্ত্রের মুখে নিচতলায় নামিয়ে আনে। এরপর একটি কক্ষে নিয়ে ঘাতকরা নির্মম ব্রাশফায়ার শুরু করে। ঘাতকের ক্রমাগত ব্রাশফায়ারে একে একে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার স্ত্রী আমিনা বেগম, পুত্রবধূ সাহান আরা বেগম, শহিদ সেরনিয়াবাত ও কোলে থাকা সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতসহ অন্যান্যরা। পরে ঘাতকরা আবার ফিরে এসে দ্বিতীয় দফায় গুলি চালায়। এসময় ভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়ে যায় আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, তার একমাত্র মেয়ে কান্তা সেরনিয়াবাত ও দেড় বছরের পুত্র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। ঘাতকের গুলিতে সেদিন আরও নিহত হয়েছিলেন বরিশালের ক্রিডেন্স ব্যান্ড গ্রুপের সদস্য আব্দুর নাঈম খান রিন্টু ও আহত হন ক্রিডেন্স ব্যান্ডের সদস্য ডাঃ খ.ম জিল্লুর রহমানসহ অনেকে।
পরেরদিন সকালে তৎকালীন রমনা থানার ওসি এসে আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে দীর্ঘ চিকিৎসায় গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে যান রব সেরনিয়াবাতের স্ত্রী আমিনা বেগম, মেয়ে বিউটি সেরনিয়াবাত, ছেলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতসহ কয়েকজন। সেই কষ্ট এখনও তাড়িয়ে ফেরে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে। প্রত্যক্ষদর্শী গুলিবিদ্ধ সহধর্মিণী সাহান আরা বেগমকে নিয়ে আজও শোকদিবস পালন করছেন তিনি।