ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

পঁচিশে বৈশাখ স্মরণে প্রবীর বিকাশ সরকার

রবীন্দ্র-ওকাকুরার অজানা ইতিহাস

প্রকাশিত: ২১:২৭, ৬ মে ২০২২

রবীন্দ্র-ওকাকুরার অজানা ইতিহাস

১৯১৩ সালে এশিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম নোবেল পুরস্কার অর্জনের পরপরই জাপানে তাঁকে নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। ভক্তরা তাঁকে সরকারের সমর্থনপুষ্ট আমন্ত্রণ পাঠান ১৯১৫ সালে। কিন্তু তারও অনেক আগে রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণের ইচ্ছে পোষণ করলেও তা সম্ভব হয় না রাজনৈতিক কারণে। ১৯০২ সালে জাপানী মনীষী শিল্পাচার্য ওকাকুরা (কাকুজোও) তেনশিন কলিকাতায় স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। প্রায় দশ মাস তিনি ভারতে অবস্থান করলেও অধিকাংশ সময় কলকাতায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র বিপ্লবী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে অতিথি হিসেবে। তাঁর সহযাত্রী ছিলেন এক তরুণ বৌদ্ধ পুরোহিত হোরি শিতোকু। রবীন্দ্র-ওকাকুরা সম্পর্ক বাহ্যত শিক্ষা-সাংস্কৃতিক হলেও অচিরেই তা রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে এবং তা ওকাকুরার কারণেই : প্রথমত, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ তখনকার স্বাধীনতাকামী তরুণ বিপ্লবীদের স্বাধিকারের জন্য উদ্বুদ্ধ করছিলেন। বিপ্লবীদের মধ্যে চরমপন্থী অরবিন্দ ঘোষ ছাড়াও আরও একাধিক বিপ্লবী ছিলেন বলে ধারণা হয় যেমন, সতীশচন্দ্র বসু, যোগীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বারীনকুমার ঘোষ, ব্যারিস্টার পি.মিত্র, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয়ত, গুপ্ত বিপ্লবী দল ‘অনুশীলন সমিতি’ গঠনের পেছনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। জাপানে সেই সময় অত্যন্ত প্রভাবশালী গুপ্ত রাজনৈতিক সংস্থা ‘গেন্য়োওশা’র কর্মকা- সম্পর্কে ওকাকুরা জানতেন। ‘অনুশীলন সমিতি’র কর্মকা-ও অনেকটা ‘গেনয়োওশা’র মতোই ছিল। তৃতীয়ত, কলকাতায় ভারতীয়দের স্বাধীনতার প্রশ্নে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে নিজের লেখা মুদ্রিত একটি বুলেটিন বিতরণ করেছিলেন যা ব্রিটিশ সরকার সুনজরে দেখেনি, সেটা বাজেয়াপ্ত করে এবং পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার কথা ওকাকুরার প্রধান শিষ্য য়োকোয়ামা তাইকানের জীবনী থেকে জানা যায়। প্রধানত এইসব বিপ্লবী কর্মকা-ের কারণে ব্রিটিশ সরকারের বিরাগভাজন হন ওকাকুরা এবং গুপ্ত অনুচর নিয়োগ করা হয় তাঁর গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখার জন্য। অবিলম্বে তাঁকে ভারতত্যাগের নির্দেশ দেয় সরকার। এই তথ্য জাপান শীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক কাজুও আজুমার ভাষ্য থেকে জানা যায়। কাজেই রবীন্দ্রনাথ যখনই জাপান ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন তখনই ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বাধাগ্রস্ত করেছে, কারণ সরকারের শঙ্কা ছিল জাপানে বিপ্লবপন্থী জাতীয়তাবাদী প্যান-এশিয়ানিস্ট ওকাকুরা তেনশিনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ষড়যন্ত্র করতে পারেন ভারত থেকে ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করার জন্য। কারণ স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়েই ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতার সক্রিয় সমর্থক। কিন্তু শত বাধানিষেধ বলবৎ করেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপানভ্রমণকে উপলক্ষ করে দুর্ধর্ষ বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ও হেরম্বলাল গুপ্ত জাপানে প্রবেশ করে ব্রিটিশের সন্দেহ-শঙ্কা-ভীতিকে বাস্তবে পরিণত করেছিল ১৯১৫ সালে। বিপ্লবীদ্বয়কে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেন তৎকালীন উগ্র জাতীয়তাবাদী প্যান-এশিয়ানিস্ট গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু, যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উপর্যুক্ত ‘গেন্য়োওশা’ গুপ্ত সংগঠন। সে এক দীর্ঘ অজানাপ্রায় ইতিহাস। অবশ্য ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা ভ্রমণের পথে জাপানে অবতরণ করেন। বিপুল অভ্যর্থনা ও সংবর্ধনায় সম্মানিত হন তিনি, যা জীবনে প্রথম বলে এক আত্মীয়কে চিঠিতে লিখেছেনও। অভিষেক হয় জাপান-বাংলা ভাববিনিময় সম্পর্কের। ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় তাঁর জীবনে নানা কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। প্রথমত, তিনি এমন একজন বিদেশী আগন্তুকের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যাঁর সুশান্ত অথচ ক্ষুরধার ভাবমূর্তি তাঁকে বিলক্ষণ ধাক্কা দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এমন একজন প-িত ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, যাঁর রয়েছে বহুমুখী পা-িত্য বিশেষ করে, প্রাচ্যধর্ম ও শিল্পকলা সম্পর্কে। তৃতীয়ত, ‘প্যান-এশিয়ানিজম’ যার বাংলা ‘প্রাচ্যভাতৃবাদ’, সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন এই মতবাদের অগ্রদূত ওকাকুরার কাছে। কলকাতায় ওকাকুরার মুখে ‘অংরধ রং ঙহব’ আপ্তবাক্যটি শুনে বিষম নাড়া খেয়েছিলেন। এই তিনটি বিষয়ের কারণে ওকাকুরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবনে অদ্বিতীয়ম একজন মানুষ, যাঁর গভীর-গভীর প্রভাব রবীন্দ্রনাথের জীবনে সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের আমৃত্যু জাপানপ্রীতির মূল কারণই ছিল ওকাকুরার জাপান। ওকাকুরা জাপানে ফিরে এসে টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতার আয়োজন করেন যেখানে প্রায় ৭০ জন বিদগ্ধ প-িত, শিক্ষাবিদ, পুরোহিত, শিল্পীসহ গুণীজন উপস্থিত হয়ে তাঁর ভারতভ্রমণের অভিজ্ঞতা শ্রবণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যও উপস্থিত ছিলেন। এশিয়ার নতুন বন্ধু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূয়সী প্রশংসা করে বাংলার নবজাগরণ আন্দোলনে ঠাকুর পরিবারের অগ্রণী ভূমিকার কথাও তুলে ধরতে ভোলেননি ওকাকুরা। তাঁর এই ভারতভ্রমণের বর্ণনা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জাপানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ওকাকুরার সঙ্গে পরিচয়ের পর রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে জাপানের প্রতি দিনে দিনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সম্মুখে তখন তরুণ পুরোহিত হোরি শিতোকু, যার রুচি, সৌন্দর্যবোধ, বাকসংযম, আত্মসংযম, অনুসন্ধিৎসা, কর্মে নিষ্ঠা প্রভৃতি গুণের দ্বারা আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। প্রকৃতিপাগল রবীন্দ্রনাথ জাপানের প্রকৃতি তখনও দেখেননি, শুধু দেখেছেন কিছু জাপানী নাগরিক। যে প্রকৃতি পরবর্তীকালে তাঁকে আমূল বদলে দিয়েছিল। ১৯০৩ সালে ওকাকুরা তাঁর দুজন প্রধান শিষ্য চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান ও হিশিদা শুনসোওকে কলকাতায় পাঠালেন রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে। আসলে যাওয়ার কথা ছিল ওকাকুরারই, সদ্যনির্মিত ত্রিপুরা রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে চিত্রকর্মের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না পাওয়াতে উক্ত দুজন শিষ্যকে পাঠান। অবশ্য তাঁরাও সেই কাজ করতে পারেননি কর্তৃপক্ষের প্রতিবন্ধকতার কারণে। ব্রিটিশ সরকার ভাল করেই জানতো এই দুজন ওকাকুরারই শিষ্য। বিফল হয়ে মাস তিনেক তাঁরা কলকাতা ও অন্যান্য জায়গায় কাটিয়ে জাপানে প্রত্যাবর্তন করেন। এর ফলে একটা কাজ হয় জাপান-বাংলা শিল্পকলা বিনিময় সম্পর্কের সুদূরপ্রসারী দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ‘বঙ্গীয় শিল্পকলা আন্দোলনে’র পথিকৃৎ শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু প্রমুখের সঙ্গে চিন্তা-চেতনা, কলাকৌশল, রীতিনীতির বিনিময় ঘটিয়ে নতুন প্যান-এশীয় ধারা প্রচলনে সচেষ্ট হন তাঁরা। তাইকান ও হিশিদা বিভিন্ন স্থান ঘুরে অনেক হিন্দু দেবদেবী ও বৌদ্ধ প্রতিমার ছবি আঁকেন। তাঁরা স্বদেশে ফিরেও বেশ কিছু ছবি আঁকেন ভারতীয় প্রতিমাশিল্প নিয়ে। অসাধারণ সেইসব ছবির সঙ্গে বৃহত্তর বাঙালী বা ভারতীয়দের পরিচয় নেই বললেই চলে। শিল্পীদ্বয়ের পরে দুজন জাপানী দারুশিল্পের প্রশিক্ষকও ১৯০৫ সালে শান্তিনিকেতনে যান কারুশিল্প শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে। রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁদের কাজকর্ম দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১৯০৮ সালে জাপানের খ্যাতিমান তরুণ বৌদ্ধভিক্ষু কিমুরা নিক্কি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে গমন করেন পালিভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। তিন বছর মহাস্থবির মন্দিরে অবস্থান করে পালিভাষা শিখে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি ভারতীয় ধর্ম ও বাংলা ভাষা শিক্ষালাভ করে পালি বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। অসীম সাহসী ও মেধাবী শিক্ষক কিমুরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হয়ে শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে যান। কবিগুরুর সঙ্গে গভীরভাবে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। ২০ বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে জাপানে প্রত্যাবর্তন করেন। বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, বেদ ইত্যাদি নিয়ে মহামূল্যবান গ্রন্থসমূহ লিখে গেছেন। তিনি বাংলা ভাষায় পা-িত্যপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম জাপান ভ্রমণ করেন ১৯১৬ সালে তাঁর প্রস্তুতি নিতে জাপানে ফিরে আসেন অধ্যাপক কিমুরা। দোভাষী হিসেবে কবিগুরুর তত্ত্বাবধান করেন। অনুরূপ নেতাজি যখন জাপানে আসেন তাঁর দোভাষীর দায়িত্বও অধ্যাপক কিমুরা পালন করেছিলেন। ১৯১১ সালে আরেক তরুণ বৌদ্ধভিক্ষু প-িত কাওয়াগুচি একাই ভারত ভ্রমণকালে কলকাতায় ওঠেন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। শান্তিনিকেতনেও তিনি যান। অনুরূপ ১৯১৩ সালে যান প্রথিতযশা বৌদ্ধপ-িত ও ভারতবিদ অধ্যাপক ড. তাকাকুসু জুনজিরোও। তাঁর সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্ব হয়। কবির জাপান সফরের প্রস্তুতি পরিষদের তাঁরা দুজনেই ছিলেন অন্যতম প্রধান সদস্য। তাকাকুসুর সঙ্গে কবির একাধিক সাক্ষাৎ ঘটে ও পরস্পর মতবিনিময় করেন। তাঁকে উপহার দেন রেশম কাপড়ে স্বহস্তে লিখিত ধম্মপদ থেকে উৎকলিত একটি বাণীর লিপিচিত্র। আজও সেটি অধ্যাপক তাকাকুসু প্রতিষ্ঠিত মুসাশিনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। এই বিষয়ে আমার একটি প্রবন্ধও রয়েছে। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের জাপানভ্রমণ নানা দিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। যেমন শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, তেমনি রাজনৈতিক দিক দিয়েও এই ঘটনা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। এই ভ্রমণের সময় তিনি একাধিক বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন যাঁরা তাঁর প্রকৃতিনির্ভর সম্পূর্ণ মানব শিক্ষা পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁরা শান্তিনিকেতন এবং রবীন্দ্রনাথকে সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করেন, সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রভাবশালী শিল্পপতি এবং জাপানের প্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা শিল্পপতি শিবুসাওয়া এইইচি, রাষ্ট্রনায়ক এবং বিশ্বখ্যাত ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কাউন্ট ওওকুমা শিগেনোবু, য়োকোহামা বন্দরনগরীর সিল্ক ব্যবসায়ী ও শিল্পকলার বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক হারা তোমিতারোও, নারীদের উচ্চশিক্ষার্থে প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জিনজোও নারুসেসহ আরও অনেক। তিন মাসব্যাপী জাপান পরিভ্রমণ কতখানি প্রভাব ফেলেছিল তাঁর জীবনে ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থে তা অনেকটা বিধৃত আছে। সজাগ ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে তিনি জাপানকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারই প্রমাণ মেলে ‘জাপানের কথা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে, যেটা তিনি ১৯১৮ সালে লেখেন, সেখানে বলছেন, ‘আমি যখন জাপানে ছিলুম, তখন একটা কথা বার বার আমার মনে এসেছে। আমি অনুভব করছিলুম, ভারতবর্ষের মধ্যে বাঙালীর সঙ্গে জাপানীর এক জায়গায় যেন মিল আছে। আমাদের এই বৃহৎ দেশের মধ্যে বাঙালীই সর্বপ্রথমে নূতনকে গ্রহণ করেছে এবং এখনো নূতনকে গ্রহণ ও উদ্ভাবন করবার মতো তার চিত্তের নমনীয়তা আছে।’ রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান ভ্রমণকালে মেইজি যুগ শেষ হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তাইশোও যুগ শুরু হয়েছে। নূতনকে গ্রহণ ও উদ্ভাবনের জোরালো প্রবাহ তখন পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে, নূতনকে গ্রহণ ও উদ্ভাবনের মধ্য দিয়েই মাঝারি গোছের সা¤্রাজ্য জাপান পার্শ্ববর্তী উদীয়মান শ্বেতাঙ্গ মহাশক্তি রাশিয়াকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত করেছিল। এই রুশ-জাপান মহাযুদ্ধে (১৯০৪-৫) জাপানের বিপুল বিজয় সমগ্রবিশ্বকেই তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিল। সা¤্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গ শক্তিকে এই প্রথম কোনো ক্ষুদ্র একটি সংকর জাতি পরাজিত করতে সক্ষম হয়। স্বাধীন জাপান শ্বেতাঙ্গশক্তির দখলে থাকা প্রতিটি এশিয়ান জাতিকে প্রচ- নাড়া দিয়েছিল তাদের মুক্তিকামী চেতনাকে। জাপানের এই দুঃসাহসিক সমর অভিযান এশিয়ায় আন্দোলনরত জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ভারতবর্ষ তার ব্যতিক্রম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে গান্ধী, নেহরু তৎকালীন প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই অভিভূত হয়েছিলেন জাপানের এই বিরল বিজয়ে। ১৯০৭ সালে চট্টগ্রাম ভ্রমণকালে এক সভায় রবীন্দ্রনাথ জাপানের এই বিজয়কে স্মরণে রেখে বাঙালীকে জেগে উঠতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। জাপান নূতনকে গ্রহণ করে পশ্চিমাশক্তির সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল এটা রবীন্দ্রনাথও বুঝতে পেরেছিলেন, বলেছেনও তাঁর লেখায়। নূতন সমরাস্ত্রই শুধু নয়, জাপানী জাতিটাকেই তাঁর চোখে ও মননে নূতন বলে প্রতিভাত হয়েছিল। এই নূতনত্ব হচ্ছে জাপানিদের দেশাত্মবোধ, প্রকৃতিলালন, প্রকৃতিজাত সংস্কৃতি, শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদি যা তাঁর নজরে এসেছে ব্যাপকভাবে এই প্রথম। সুতরাং কবি হিসেবে, বাঙালি হিসেবে নূতনের চিরপিয়াসী রবীন্দ্রনাথ এই নূতন জিনিসগুলো জাপান থেকে ধার করে ভারতে তথা বাঙালী সমাজে প্রচলন করতে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সদ্যপরিচিত জাপানী বন্ধু ও ভক্তদের কাছে তিনি তাঁর আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন অকুণ্ঠচিত্তে। জাপানীরা তাঁর আগ্রহে ব্যাপকভাবে সাড়া দিতে মোটেই কার্পণ্য করেননি। বরং নিজেদের প্রচুর অর্থ খরচ করে শিল্পকলা-সংস্কৃতি-ক্রীড়াবিষয়ক প্রশিক্ষকদের ভারতে পাঠান রবীন্দ্রনাথের জাপানী সংস্কৃতির মূল্যায়নকে মর্যাদা দিয়ে। শিল্পপতি হারা তোমিতারোও পাঠিয়েছেন তাঁর বিশ্বস্ত শিষ্য চিত্রশিল্পী আরাই কাম্পোকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে। ১৯১৬ সালে ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত ‘বিচিত্রা’ চারুকলা ভবনে জাপানী চিত্রকলার কলাকৌশল শিখিয়েছেন। প্রায় দুই বছর অবস্থান করে বিস্তর অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন ভারতীয় চিত্রকলা সম্পর্কেও। হারা তোমিতারোও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী তরুণ শিল্পকলার শিক্ষার্থী মুকুলচন্দ্র দেকে বৃত্তি দিয়ে জাপানে রেখে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সঙ্গত কারণেই তা হয়নি। কিন্তু মুকুল দে যা শিক্ষালাভ করেছেন জাপানে প্রায় মাস তিনেক সময়ে তাতে করে আমৃত্যু তিনি জাপানের পরম ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীকালে কলিকাতায় গমনকারী জাপানি চিত্রশিল্পীদের তত্ত্বাবধান করেছেন এবং দেখে যেতে পেরেছেন ভারতের স্বাধীনতা, যে-স্বাধীনতার সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছিল ১৯০২ সালেই রবীন্দ্র-ওকাকুরার ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্ব এবং সুদূরপ্রসারী হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। কারণ, রবীন্দ্র-ওকাকুরার ভক্ত জাপানীরাই বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধকে সর্বাত্মক সমর্থন করেছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস লেখা হয়নি। তাই পাঠ্য নয় জাপান-ভারত-বাংলাদেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই!
×