ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এখনও আছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের নকশি পাখা

শুধু শীতল বাতাস নয়, স্নেহস্পর্শ শৈল্পিক পরম্পরা

প্রকাশিত: ২৩:২২, ১৮ মে ২০২২

শুধু শীতল বাতাস নয়, স্নেহস্পর্শ শৈল্পিক পরম্পরা

মোরসালিন মিজান ॥ গ্রীষ্মের সে কী দাপট এখন! প্রকৃতি উত্তপ্ত হয়ে আছে। গরম বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। তবে এজন্য সবাইকে সমানভাবে ভুগতে হচ্ছে এমন নয়। বৈদ্যুতিক পাখা আছে প্রায় সব ঘরে। এমনকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বিপুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যয়। তদুপরি দেশে শতভাগ বিদ্যুত নিশ্চিত করা হয়েছে। গরম নিয়ে আলাদা করে ভাবার তাই প্রয়োজন পড়ে না। একই কারণে খোঁজ করতে হয় না হাতপাখাটির। হ্যাঁ, একরকম হারিয়েই গেছে। তাই বলে হাতপাখার যে ঐতিহ্য, সে তো হারাবার নয় কোনদিন। কিছুকাল আগেও গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের খুব উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ ছিল হাতপাখা। তখন দেশের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুত ছিল না। বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহারও খুব কম চোখে পড়ত। মানুষ গরম থেকে বাঁচতে মূলত হাতে তুলে নিত হাতপাখা। তোমার হাত পাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে...। সত্যি প্রাণ জুড়াত হাতপাখার বাতাসে। বিভিন্ন রকমের নক্সি পাখা তৈরি হতো গ্রামবাংলায়। তালপাতার পাখার কথা তো সবারই জানা। বাঁশ বা বেত দিয়েও পাখা তৈরি করা হতো। অনেকটা পাটি বোনার মতো করে পাখার মূল অংশ বুনে নেয়া হতো। বাঁশ ফালি করে কেটে ধারালো দায়ের সাহায্যে পাতলা লম্বা বেতি বের করা হতো। বেতির বুননের মাধ্যমে পাখার বিভিন্ন নক্সা করা হতো। বেতিতে উজ্জ্বল রং মেখে নিয়ে তা দিয়েও পাখা বুনা হতো। ফলে পাখাগুলো আলাদা দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হতো। তবে নক্সি পাখা বলতে প্রধানত সূচিকর্ম করা পাখার কথা বোঝায়। নক্সি কাঁথার কথা আমরা জানি। নক্সি পাখার বেলায়ও নানা নক্সা করা হতো। নারীরা পাখার মাঝখানটায় যতেœর সঙ্গে সূচিকর্ম করতেন। সুই সুতোর বুননে বিভিন্ন লোক মোটিফ তুলে ধরতেন। লতা পাতা ফুল পাখি মাছ গাছ ইত্যাদির উপস্থাপনা দেখা যেত হাতপাখায়। ফলে হাত ঘুরালে শীতল বাতাস যেমন পাওয়া হতো, তেমনি মুগ্ধ করত এর কারুকৃতি। গ্রামীণ নারীদের পতি-প্রেম পতি-ভক্তির বিচিত্র প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। দেখা গেছে। তবে একটি দৃশ্য সবার স্মৃতিতে নিশ্চিতভাবেই রয়ে গেছে। স্বামীর সামনে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। তিনি খাচ্ছেন। আর পাশে বসে আছেন স্ত্রী। তার হাতে একটি নক্সি পাখা। এক হাতে স্বামীকে বাতাস করে চলেছেন তিনি! এভাবে বাতাস করার মধ্য দিয়ে মূলত নিজের গভীর ভালবাসাটুকুই প্রকাশ করতেন নারীরা। পতিদেবতাটি মুখে হয়তো কিছু বলতেন না, ভালবাসা অনুভব করতেন ঠিকই। অতি আপনজন বন্ধু বা ভালবাসার মানুষকেও উপহার হিসেবেও দেয়া হতো নক্সি পাখা। সুই সুতোর নক্সার মাধ্যমে এ পাখাগুলোকে বিশেষ আকর্ষণীয় করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যেত। লোকঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে অনেক কাজ করেছেন জিনাত মাহরুখ বানু। তার বর্ণনা মতে, একসময় বাঁশের গোল চাকতিতে সাদা কাপড় মুড়ে তাতে সূচিকর্মের মাধ্যমে নানান ধরনের ফুল ও লতাপাতা চিত্রিত করা হতো। এ ধরনের পাখার চতুর্দিকে থাকত লালসালুর ঝালর। পাশাপাশি নক্সি পাখায় সুতার বুননের সাহায্যে বিভিন্ন নক্সা করা হতো। সাধারণত বাঁশের হাতলের সঙ্গে বাঁশের গোল চাক বা চটি সংযুক্ত করা হতো। চাকে শাড়ির পাড়ের সুতার সাহায্যে টান টান করে পর্দা দেয়া হতো। এ সুতার ভিতর দিয়ে সুচের সাহায্যে অন্য রঙের সুতা দিয়ে বিভিন্ন জ্যামিতিক নক্সা তুলে ধরা হতো। পাখায় বুননের মাধ্যমে বিভিন্ন ছড়া ও প্রবাদ ফুটিয়ে তোলা হতো। ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে’, ‘দিন যায় কথা থাকে, সময় যায় ফাঁকে ফাঁকে’ ইত্যাদি হতে পারে তার উদাহরণ। হাতের কাজের ধরন অনুযায়ী পাখার নামও বদলে যায়। এই যেমন- কোনটির নাম ‘পদ্ম পাঙ্খা, কোনটি পাঁচ ফুইল্যা, কোনটির নাম আবার শত ফুইল্যা।’ সন্ধ্যা রানী নামের এক শিল্পী ঢাকায় এক মেলায় অংশ নিয়েছিলেন। তখন এই নামগুলোর কথা জানিয়েছিলেন তিনি। নামকরণের ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘যেই পাখায় একশ’ ফুল থাকে সেটির নাম শত ফুইল্যা। আর যেইটাতে ফুল পাঁচটা, সেইটা পাঁচ ফুইল্যা! আশার কথা যে, এখনও নক্সি পাখার চর্চা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। দেশের বিভিন্ন গ্রামে কম বেশি হাতপাখা তৈরি হচ্ছে। এমনকি ঢাকার খুব কাছে সোনারগাঁয়ে অনেকগুলো ঘরে তৈরি হয় নক্সি পাখা। বংশপরম্পরায় অনেক নারী এ সূচিকর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তাদেরই একজন বাসন্তী। সব মিলিয়ে কী অবস্থায় আছে নক্সি পাখা? জানতে চাইলে মাঝবয়সী নারী বলেন, পরিবার থেকেই এই কাজ শিখেছিলাম। ছোট বেলার শিক্ষা। এখনও ভালবাসি। ভালবাসি বলেই আসলে করি। নক্সি পাখার ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুন্দর জিনিস তো, শৌখিন মানুষেরা বাড়িতে এসে কিনে নিয়ে যায়। আর গরিব মানুষেরা বাতাস করার জন্য কেনে। বিক্রি কম হলেও, চর্চা চালিয়ে যাবেন বলে জানান তিনি। সোনারগাঁয়ের আরেকটি বাড়ির প্রায় সব নারী নক্সি পাখা তৈরি করেন। বাড়ির বউ লতা সূত্রধর, সন্ধ্যা সূত্রধর, মেয়ে রীতা সূত্রধর সূচিকর্মের অংশ হিসেবে পাখার কাজ করছেন। কথা প্রসঙ্গে লতা রানী বলছিলেন, আমি শাশুড়ির কাছ থেকে ভালভাবে কাজটা শিখেছিলাম। এখন তিনি নেই। আমি করছি। কিন্তু চাহিদা কেমন? জানতে চাইল অবাক করে দিয়ে তিনি বলেন, খুব ভাল। এখন গরম বেশি। অনেকে পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এর বাইরে ঢাকার দেশীয় বড় বড় শোরুমে যাচ্ছে আমাদের পাখা। চাহিদা বেশি থাকায় বাড়ির বেকার মানুষেরাও এ কাজে হাত লাগিয়েছে বলে জানান তিনি। তার কথা শুনে কেবলই মনে হচ্ছিল, এর চেয়ে ভাল খবর আর কী হতে পারে!
×