ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

নীতির আলেখ্য

প্রকাশিত: ০০:০৬, ১৪ জানুয়ারি ২০২২

নীতির আলেখ্য

শফিক হাসানের বই ‘নীতি কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ প্রকাশ করেছে শুদ্ধ প্রকাশনী। প্রচ্ছদ-চারু পিন্টু। ২০২০ এর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটির প্রথম প্রকাশ। করোনা দুর্যোগের আগ মুহূর্তে ২০২০ সালের অমর গ্রন্থমেলাই সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক উৎসব ও আয়োজনের আড়ম্বর পর্ব। ২০২০ সালের একুশে বইমেলা শেষ হতে না হতেই মার্চ মাসের আট তারিখ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। বছরটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের হরেক রকম অনুষ্ঠানের মহাসম্মিলনে সাজানো গোছানো। কিন্তু করোনার প্রবল থাবায় সবকিছু বানচাল হয়ে গেলে প্রযুক্তির বিশ্বে নতুনভাবে অনুষ্ঠান সম্পৃক্ত হওয়াও এক ভিন্ন মাত্রার আয়োজন। শফিক হাসানের প্রবন্ধ সঙ্কলনের আলোচনায় উঠে আসে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যিক ভাব সম্পদে গড়ে ওঠা প্রবাদপ্রতিম নীতি আলেখ্য বচন, চেতনাসমৃদ্ধ জীবন গড়ার অনন্য সৌধ। আধুনিকতার তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারিত বিশ্বে হারিয়ে যাওয়ার পথে নীতিনিষ্ঠতায় পরিপূর্ণ কাব্য মহিমা, এবং কবিতার ঝঙ্কৃত ছন্দোবদ্ধ আবহ। সেই প্রাচীনকাল থেকেই সৃষ্টিযজ্ঞের অনবদ্য শৌর্যে যা লিখিত কিংবা প্রবাদে যুগ থেকে যুগান্তরে আবর্তিত হতো তা যেন মানবতা, মনুষ্যত্ব আর ব্যক্তিক আদর্শায়িত জীবনের পরম সৌধ। শুধু কবিতা নয়, গল্প, যুক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধ এমনকি যে কোন ধরনের রচনায়ও শোভা পেত যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার নানাবিধ ন্যয়বোধ আর নীতি নৈতিকতা। আর যিনি সৃজনযজ্ঞে নিজেকে সমর্পিত করতেন তার মধ্যেও এক অনাবিল আদর্শনিষ্ঠ মূল্যবোধের যথার্থ নির্দেশনা থাকত। লেখক প্রাচীনকাল থেকে উনিশ শতকের নবজাগরণীয় আবহে তৈরি হওয়া বিজ্ঞ ও প-িতজনদের সরাসরি উদ্ধৃত করে তাদের নমস্য হিসেবে বিবেচনায় এনেছেন। তারা কোন কাল, দশক কিংবা যুগের সে সব বিষয়কে জোরালো মনন শক্তিতে অতিক্রম করে চিরস্থায়ী নান্দনিক সত্তায় তাদের অভিষিক্তই শুধু নয় অর্ঘ্য নিবেদনেও কার্পণ্য করেননি। শুরুতেই বহুবার পড়া ঈশপের গল্পের অবতারণা করে সেখান থেকে সবাই বিশেষ করে শিশুরা যে নীতি নৈতিকতায় প্রলুব্ধ হয় তা যেন আদর্শ নিষ্ঠতায় তৈরি হওয়ার নির্ণায়ক। ঈশপের গল্প বলার অসাধারণ দক্ষতা মহামূল্যবান এবং অতুলনীয়। আগে গল্প বলার মধ্যে যে ছন্দ এবং শিল্পীত অনুরণন কাজ করত এখন তা ছন্দোবদ্ধ কবিতায়ও অপসৃত। ছন্দকে হারিয়ে কবিতার যে অন্য মোড়ক গদ্যের আবরণে সেটাও লেখককে ভারাক্রান্ত করে তোলে। নতুন সময়কে ধরতে গিয়ে ঐতিহ্যিক মানবিক বোধগুলো আর খুঁজে পাওয়া দায়। মধ্য যুগের স্বনামধন্য কবি চন্ডীদাসের মানুষকে নিয়ে যে সার্বজনীন মূল্যবোধ তেমন নিষ্ঠতার পরিচয় বর্তমান সময়ে খুঁজে না পাওয়ার কষ্টও লেখককে তাড়িত করে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথ প্রদর্শক কবি ঈশ্বরগুপ্তের অমৃত বাণী আজও যে অম্লান তা নিয়ে গ্রন্থকারের কোন সন্দেহ নেই। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে যুগের অপ্রতিহত দাবিতে আধুনিকতার যে উন্মেষ সেখানে ঈশ্বর গুপ্ত তার সমৃদ্ধ অতীতকে সমধিক গুরুত্ব দিতে একেবারে উচ্চকণ্ঠ। সে সময়ের বহু কবিতায় দেশ, মানুষ আর মাতৃভাষার প্রতি যে অবিমিশ্র নিবেদনের স্তুতি তৎকালীন কবি-সাহিত্যিক তার থেকে মোটেও সরে দাঁড়াননি। নীতিনিষ্ঠ কাব্যিক ঝঙ্কারও অনবদ্য বচন চয়নে সর্ব মানুষের জয়গান গেয়ে মনুষ্যত্বের যে ধ্বজা তুলে ধরেন কালের গর্বে তা আজও মহীয়ান। তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারিত যুগে সমৃদ্ধ গ্রন্থকে যখন সীমাবদ্ধ করে রাখা হয় সেখানে লেখক এবং সৃজনসম্ভার উভয়েই তার যথাযথ মান থেকে সরে দাঁড়ান। এখনকার সৃজন ও মনন সত্তা আদর্শ আর নীতি নৈতিকতাকে তার নান্দনিক বোধে সেভাবে আমলেও নেন না। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুকান্ত ভট্টাচার্য, জীবনানন্দ দাশ, শেখ ফজলুল করিমদের মতো ঐশ্বর্যবান সৃজন ব্যক্তিত্ব যে মাত্রায় মানুষের জয়গান গেয়েছেন তেমন সার্বজনীন সঙ্গীত অতি আধুনিক এই যুগেও বিরল। পুরো গ্রন্থেই গ্রন্থের রূপকারের আক্ষেপ আর অনুতাপ কেন এমন সব ঐতিহ্যিক সম্ভার নতুন সময়ের প্রতিনিধি হয়ে নব আঙ্গিকে তৈরি হতে পারছে না। আধুনিক শিল্প আর প্রযুক্তির বৃহৎ আয়োজনে পুরনো সমৃদ্ধ চেতনাকে ফিরিয়ে আনা কতখানি সম্ভব তা বলা মুশকিল। লেখকের ভাষা এবং বোধ অত্যন্ত রুচিসম্মত এবং শৈল্পিক শৌর্যে অনবদ্য। শব্দ চয়নের বাহুল্য নেই কিন্তু ব্যাপ্তি এবং গভীরতা কতখানি তা সত্যিই সচেতন পাঠকদের মুগ্ধতার আবেশে নিয়ে যায়। তথ্যপ্রযুক্তিকে অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা নয় বরং ঐতিহ্যকে জীবনের অনুষঙ্গ করতে যা যা করণীয় সাধ্যমতো করার পরামর্শ এসেছে মাত্র। গ্রন্থটি পাঠককে সমৃদ্ধ অতীতের সঙ্গে সম্মিলন ঘটাবে। পাশাপাশি আধুনিকতার নির্মাল্যকেও সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। চমৎকার ও অভিনব গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে নিঃসন্দেহে। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
×